টানাপোড়ন

ছেলেটা সেই কখন থেকে গাল ভার করে আছে বাবার কাছে যাবে বলে।  আট বছরের ছেলেকে শায়লা কিভাবে বুঝায় যে, বাবাকে চাইলেই পাওয়া যাবে না!
শায়লা পরম আদরে ছেলের মাথায় হাত রাখে, তার ভেতরটা কেঁদে উঠে।  ছেলেকে ডাকে,
-হামি
-হুম। ঠোঁট ভেঙে হামি জবাব দেয়।
-বাবা সামনের সপ্তাহে আসবে তোমাকে দেখতে
-নাহ! আমি বাবাকে এখন দেখতে চাই
– বাবা তো অনেক দুরে থাকে বাবা। বললেই আসতে পারবে না।

শায়লার কপালে বিরক্তির ভাঁজ পড়ে। হামি দু’হাতে মা’কে জড়িয়ে ধরে বলে,
-মাম!, বাবা কেন আমাদের সাথে থাকে না? বাবা থাকলে কি হয়?
শায়লা কোন জবাব দেয় না। এমন প্রশ্ন হামির আজ নতুন নয়। প্রায় সময়ই শায়লাকে নানান প্রশ্ন শুনতে হয় হামির মুখে। শায়লা এড়িয়ে যায়।

তেত্রিশ বছর বয়সী শায়লা জামান একটি ফুটফুটে ছেলের মা। সেলিমের সাথে তার সেপারেসন হয়ে গেছে আজ তিন বছর। হামি তখন পাঁচ বছরের ছোট শিশু। কিছুই বুঝতো না সম্পর্কের টানাপোড়ন। এখন সে কিছু কিছু বুঝতে শিখেছে। সেলিমের সাথে ডিভোর্সটা এখনো হয়নি। কেইস চলছে। কিন্তু হামি চায়না তারা আলাদা হোক। অন্যদিকে পরিবা্রের ভাই-বোন, কিছুটা নিজের অবচেতন মনের আবেগও যেন শায়লার মুক্তির পথে বিশাল বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কি করবে ভেবে পায়না শায়লা। একদিকে তার রক্ষণশীল বাবা-ভাইদের পরিবারের সন্মানহানীর ভয়, অন্যদিকে হামি।

শায়লার মা বলেছিল, ‘শায়লা রে। কি দরকার! গুঁজামিলে দেখনা সংসারটা যদি টিকে যায়!”
কিন্তু শায়লা মেনে দিতে চায়নি। সংসার রক্ষায় নারীকেই কেন সব মানিয়ে নিতে হবে? বলেছিল মা’কে, ‘মা! তুমি যা করেছো, তুমি কি চাও তোমার মেয়েও তা করুক? তুমি কি দেখোনা কাঁথার নিচে লুকিয়ে তোমাকে মারতে দেখে আজ আমি তোমার স্বামীকে কতটা ঘৃণা করি?’
শায়লার মা আর কোন কথা বাড়ায়নি। তিনি জানেন, মেয়ে বড্ড জেদি। বড় সচেতন। এই মেয়ে তার সন্তানকে কোন ভয়ানক স্মৃতি আঁকড়ে বেড়ে উঠতে দিবে না।

 

*
হামির গোসল শেষ। গুটিগুটি পায়ে টাওয়েলটা গা’য়ে জড়িয়ে মা’য়ের পাশে এসে দাঁড়ালো।
-মাম আজ কি ভাত খাবো?
– হুম। আজ সর্ষে ইলিশ করেছি। ভাত খাওয়া হবে। তুমি কাপড় বদলে এসো।
যদিও ইলিশ মাছের কাঁটা তুলে খেতে পারেনা হামি, তবে ডিমটা তার খুব পছন্দ। শায়লা নিজেও ইলিশ ছাড়া আর কোন মাছ খায়না। তবে, সর্ষে ইলিশ তার পছন্দ না। সর্ষে ইলিশ রিয়াদের খুব পছন্দ।  একদিন রিয়াদকে সর্ষে ইলিশ রান্না করে খাওয়াবে বলে ভাবছে শায়লা।

রিয়াদের সাথে শায়লার সম্পর্কটা বলা যায় কিছুটা আড়ালের । একি অফিসে কাজ করার সুবাদে দু’জনের পরিচয়। তারপর কথা বলা, বন্ধুত্ব, ধীরে ধীরে আন্তরিকতা বাড়তে থাকা। একসময় অন্যরকম ভালো লেগে যাওয়া। সেই থেকেই শায়লার হাজারো হতাশার মাঝে একটুকরো আনন্দ যেন রিয়াদ। এ যেন লুসিফেরিন গা’য়ে রাঁতের আঁধারে মিটিমিটি করে জ্বলা জোনাকি পোকা।
ওদের সম্পর্কটা নিয়ে প্রায়ই ভাবে শায়লা। রিয়াদ  টগবগে এক তরুণ যুবক।  স্বভাবে শান্ত, ভদ্র, শিক্ষিত। কেন যে শায়লাকে ভালোবেসে ফেললো!  তাছাড়া, শায়লার এখনো ডিভোর্স হয়নি,শায়লাই বা কেন দুর্বল হয়ে গেলো তার প্রতি! কত কি ভাবনা আসে শায়লার মনে।

 

মনে আছে তার, ছোটবেলা পাড়ার এক লোক হাতের রেখা দেখে তার অশুভ ভাগ্যের কথা অগ্রিম বলে দিয়েছিল মা’কে।  লোকটা বলেছিল, আপনার মেয়ের জীবনরেখায় বয়সের সাথে সাথে অসংখ্য ছেদকারী ছোট রেখা আছে। এগুলো ভালো না,  এগুলি বাধা রেখা।  এই মেয়ের জীবনে অনেক দুর্ঘটনা আসবে।
শায়লার মা তখন খুব রাগ হয়েছিলেন, কিন্তু ভয়ও পেয়েছিলেন। সেই থেকে শায়লাকে খুব গা  ঘেঁষে রাখতেন তিনি।
শায়লা আজ ভাবে, মায়ের গা ঘেঁষে থাকলেই কি সন্তানের ভাগ্য পরিবর্তণ হয়ে যায়?

 

ভাবনার ছেঁদ কেটে হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠলো। রিয়াদ ফোন করেছে।

-হুম। বলো।
-কি করছো? ওপাশ থেকে জিজ্ঞেস করল রিয়াদ।
-টেবিলে খাবার রেডি করছি।
-কি রেঁধেছো আজ?
– ছেলের আর তোমার পছন্দের সর্ষে ইলিশ খুব যত্ন করে রেঁধেছি, সম্ভব হলে চলে আসো।
-তোমার নিজের কোন পছন্দ নেই শালু? নিজের পছন্দকে এতো যত্ন করতে দেখিনি তোমাকে কখনো, এটা কেন?
-আচ্ছা, রাখি এখন, হামি চলে এসেছে খাবার দিবো। পরে কথা বলছি…
– এই শোন, শোন, তোমার দুপুরের ওষুধ নিও। ভুলে যেও না……।

রিয়াদ কথা শেষ করার আগেই শায়লা ফোনটা কেটে দিলো। ইতিমধ্যে হামি খাবার টেবিলে চলে এসেছে। এখন মা- ছেলে খাবে। ভাত না খেয়ে অভ্যস্ত ছেলে আজ ভাত খাবে। শায়লা ইলিশ মাছের ডিমটা হামির জন্য পাতে তুলে নিলো।

 

*

সকাল বেলাটা খুব ব্যস্ত কাটে শায়লার। ফজরের নামাজ আদায় করে আর ঘুমায় না। টুকিটাকি কাজগুলো সেরে নেয়। ছয়টা বাজতেই হামির ঘুম ভাঙানোর চেষ্টা করে শায়লা। গড়াগড়ি করে ছেলের উঠতে সময় লাগে বেশ। তারপর ফ্রেস হয়ে মা-ছেলের সকালের নাস্তা, লাঞ্চবক্স রেডি করা, ছেলেকে স্কুলে রেখে কাজে যাওয়া! । সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত অফিস সামলিয়ে আবারো ছেলেকে ডে-কেয়ার থেকে তুলে নিয়ে বাড়ি ফিরা, এভাবে চলে শায়লার প্রতিটা দিন।

আজ ঘুম ভাঙতেই রিয়াদের কল এলো।
-উঠেছো? ঘুম জড়ানো কণ্ঠে রিয়াদ জানতে চাইলো।
-হুম, এখনো বিছানায় আছি, উঠবো।
-হামি ঘুমাচ্ছা?
– হ্যাঁ
– হামিকে একটা আদর দিও আমার
-ঠিক আছে, এখন রাখো
– আচ্ছ শোন, আমি তোমাকে ছোট্ট একটা আদর দিচ্ছি, তুমি হামিকে ট্রান্সফার করে দিও।
শায়লা হেসে উঠলো। বললো, পিটানি খেতে শখ জেগেছে বুঝি! ফোন রাখো।

ফোন রাখতেই শায়লা বালিশটকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। আরো কিছুক্ষণ গড়াগড়ি করা যাক। ঘুম ভেঙে কিছুক্ষণ বিছানায় গড়াগড়ি করা শায়লার পুরানো অভ্যাস। ছেলেও একি অভ্যাস পেয়েছে।  বালিশে মুখ গুঁজে নিয়ে শায়লা ভাবছে, আচ্ছা! রিয়াদের এই ছোট্টছোট্ট দুষ্টুমিগুলো এত ভালো লাগে কেন তার!
অফিসের ফাঁকেও রিয়াদ প্রায়ই সুযোগ পেলে এমন সব খুনসুটিতে মেতে উঠে। ভালোই লাগে শায়লার। ভালোবাসার ভিন্ন স্বাদ-মোহে মাঝে মাঝে মনে হয়, জীবনটা আসলেই উপভোগের। শায়লার ভাবগম্ভীরতার আড়ালে রিয়াদ ঠিকই বুঝতে পারে, শায়লার ভাললাগা-মন্দলাগা গুলো। শায়লা যে তার সর্বাবস্থায় হামিকেই প্রাধান্য দিতে চায়, তাও রিয়াদ ঠিকই বুঝে।
এমনি করে দিন যায় সপ্তাহ যায়, বছর যায়। ওদের সম্পর্ক আজ দুই বছরে দাঁড়ালো।  আর রিয়াদ ততোদিনে এই লুকোচুরি খেলার ইতি টানতে ব্যাকুল হয়ে উঠল।

পরিবারের বড় ছেলে রিয়াদ। ছোট্ট দু’বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। । বাবাও গত হয়েছে প্রায় সাত বছর। রিয়াদ কাজে বের হলে বৃদ্ধা মা ঘরে একা থাকে। বয়েসের কারণে সহযোগী এখন রিয়াদের মা’য়ের জন্য প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে।  রিয়াদকে এবার বিয়ের জন্য তার পরিবারের অন্যরা তাড়া দিচ্ছে।
গতমাসে শায়লাকে রিয়াদ বিষয়টা জানায়। কিন্তু শায়লা নিরুত্তর। কি করবে ভেবে পায়না। শায়লার এখনো ডিভোর্স কেইস চলছে কোর্টে।  তাছাড়া ছেলেটা সবে আট বছরে পা রেখেছে।  এখনো জীবন  নিয়ে, সম্পর্ক নিয়ে ভাবতে শিখেনি। এখনো তার অবুঝ মন বারবার বাবাকে ডাকে, মা’কে জড়িয়ে থাকে। এই অবুঝ ছেলে কি তার মা’কে অন্য কারো সাথে ভাগ করতে চাইবে?
শায়লার মন বিষাদে ভারাক্রান্ত হয়। গল্পের পর গল্প তৈরি হওয়াই জীবন,সে জীবনে আর কতই বা দৌড়ঝাঁপ কবার  সাহস থাকে!

 

সেদিন বিষয়টা নিয়ে কথা কাটাকাটির মাঝখানে শায়লা বলেছিল,তুমি তো আমার সব দায়বদ্ধতা জানতে রিয়াদ। বলেছিলে পাশে থাকবে,  এখন চাপ দিচ্ছো। জানি তোমারও  দায়িত্ব রয়েছে পালন করার। কিন্তু আমার যে এখন অবেলা, আমার জন্য সময় এখনো অণুকুলে নয়। আমি চাই, তুমি তোমার জন্য উপযুক্ত সিদ্ধান্তটাই নিবে।

 

চলে যাওয়া সহজ, যেতে দেওয়া নয়! মানুষগুলো কাছে আসে, আবার চলেও যায় অবুঝের মত এক বুক অভিমান নিয়ে, পরিশেষে রেখে যায় কিছু ছড়ানো ছিটানো মায়া। এ মায়া বড় ভয়ংকর! এই মায়ার টানেই কষ্টের ভাগ দ্বিগুন হয়। মন বার বার পিছু ফিরে দেখে, হারানো মুখগুলো স্মৃতির ডানায় ভর করে বার বার বেদনার অশ্রু হয়ে ঝরে দু’চোখে।
যে যাবার, সে তো যাবেই। তাকে ধরে রাখা যায় কি? ঐযে ছোটবেলায় পাড়া লোকটা জীবন রেখায় ভাগ্য দেখেছিল, তাও তো ফেলে দেয়া যায় না!

 

কিছুটা অভিমান, কিছুটা অপারগতা মিলিয়ে সেদিনের পর থেকে শায়লা আর যোহাযোগ করেনি রিয়াদের সাথে । সেই ছিল তার সাথে শায়লার শেষ কথা।
অথচ, এখনো ঘুম ভাঙতেই ফোনটার দিকে তাকিয়ে থাকে শায়লা। মনে হয়, এই তো আসবে একটা মেসেজ, যেখানে জানতে চাওয়া হবে- ঘুম ভেঙেছে কি? কেমন আছো?