বেঈমানের বেটি নাজমা
শমশের আলীর মা চেঁচাচ্ছেন। রাগে তার চোখমুখ ফেটে পড়ছে। পাশে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন শমশের আলী। “তরে কইসিলাম রে শমশের….বউরে দুনিয়া চিনাইস না! হেরে কলেজ যাইতে দেইস না! কথা হুনলি না, অহন বুঝ! বউ তালাকনামা লইয়া আইসে! বংশের ইজ্জত আর রইলো না। কুলাঙ্গার পুলা তুই গলায় দড়ি দে। এই দিন দেহার লাগি কি বউরে কলেজ পাঠাইসিলি রে শমশের? ওহ আল্লাহ! ওই বেঈমান বেডির বিচার করো। আমার পুলারটা খাইয়া পিন্দা হে আমার পুলার লগেই বেঈমানি করলো!” শমশের আলীর মা মাটিতে বসে সেই কখন থেকে কাঁদছেন আর অভিশাপ দিয়েই যাচ্ছেন নাজমাকে। নাজমা খুব শান্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে নারিকেন গাছটার গায়ে হেলান দিয়ে। হাতে তার সাদা কাগজে সিল মারা একটি খাকি রঙের বিবর্ণ খাম। আজ আকাশে মেঘ করেছে। ভোর থেকেই মেঘের গুরু গুরু শব্দ পাওয়া যাচ্ছিলো। আলো ফুটতেই বাজের ঝলকানি আর বৃষ্টি।মা বলেছিল, “যাইস নে নাজমা। তাগর কোন ভরসা নাই, কী থেইকা কী কইরা বয়! কাউরে দিয়া খাম পাঠাই দিমু নে।” নাজমা তবু বের হলো। সাদা কাগজে জীবনের কালো অধ্যায়টুকুর সমাপ্তি সেরে এখন সে ঝড়বৃষ্টি মোকাবেলায় প্রবল উদ্যম। আজ মৌতাতের মতই যেন যা আছে বাকী তা শেষ করার তাগিদ অনুভব করছে নাজমা। শ্লোক বাজছে। ভেতরের সব তাপ–উত্তাপ সব মহাকর্ষীয় সুর হয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে প্রান্তের দিকে। আজ শেষটুকু শেষ হতেই হবে। এখন অবশ্য বৃষ্টি নেই, আর্দ্রীকৃত ভূমিতে রোদের কোন তাপও নেই, যা আছে তা ক্যাতক্যাতে কাদা, সাথে ভিজা পায়ে ছিঁড়া স্যান্ডেল। নাজমা বেগম আর শমশের আলীর সংসার ছিল ছয় বছরের। একটি মেয়ে রয়েছে তাদের। স্বামী মাদকাসক্ত, পাড়ার লোকেরা বলেন ‘মদখোর’/’গাজাখোর! নাজমার বয়স যখন ১৮, তখন তার বিয়ে হয় শমশের আলীর সাথে। বিয়ের বছর খানেক পরেই কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। নাজমা বিয়ের পর থেকেই জানতো তার স্বামী মাদকাসক্ত। কিন্তু আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল পরিবারের একটি মেয়ে হয়ে, সংসারে থেকে যাওয়া ছাড়া বিকল্প আর কিছুই ছিল না তার সাধ্যে। এ নিয়ে নাজমা তার বাবাকে কিছুই জানায়নি। কারণ সে জানে, জানিয়ে কোন কাজ হবেনা, তার বাবাও মাদকাসক্ত। মা’কে বলেছিল সব। কিন্তু মায়ের অশ্রু বিসর্জন দেয়া ছাড়া আর কিছুই করার ছিলনা। নাজমা বহুবার বাধা দিতে চেয়েছে শমশেরকে। কোন লাভ হয়নি। উল্টো এ নিয়ে কথা বলতে গেলেই নাজমার উপর চলতো গালাগালি, শারীরিক নির্যাতন। শাশুড়ী বলতেন ”সহ্য করো গো মা। আমরা এর থেইকাও অনেক বেশী কিছু সহ্য কইরা সংসার করসি। কার ঘরে নেশাপানি না হয়! পুলারা এরুম একটু আধটু করেই। কি আর করা! মাইয়া মানুষের কপালই এমন।” নাজমা তার মা–শাশুড়ির মত ‘মাইয়া লোকের কপাল’কে মানতে চায়নি। সে চেয়েছিল একটি ‘নিজ’ কপাল গড়তে। তাই সে উপায় খুঁজছিল কিভাবে এই সঙ্কট থেকে মুক্ত হওয়া যায়। নাজমা চায়নি তার সন্তান বড় হয়ে কোনদিন একই নিয়মে জীবন টানবে, অধিকার,স্বাধীনতা ভুলে গিয়ে অন্যায়, অত্যাচার মেনে নিয়ে কারো ঘর করবে। নাজমা চেয়েছে পরিবর্তন। আর তাই সে দীর্ঘদিন চেষ্টার পর খুব কৌশলে স্বামীকে মানিয়ে নিয়ে প্রতিবেশীর সাহায্যে কলেজে ভর্তি হয়। নাজমা পড়াশুনা সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত নেয়। কারণ সে জানতো, প্রতিবাদ করতে হলে, নিজ অধিকার আদায় করতে হলে তাকে স্বাবলম্বী হতে হবে। তাকে নিজ পায়ে দাঁড়াতে হবে। সহজ ছিল না পড়াশুনা নিয়মিত করা। তবু সব কিছু মেনে নিয়ে নিজ নির্ধারিত গন্তব্যে পৌঁছাতে নাজমা তার প্রচেষ্টায় অটল থেকেছে। কতবার যে পরীক্ষার আগ মুহূর্তে নাজমার সমস্ত বই খাতা ছিঁড়ে ফেলেছে শমশের! তবু একটা শব্দ উচ্চারণ করেনি সে, ছিঁড়ে ফেলা টুকরো টুকরো কাগজগুলো একসাথে করে স্কচটেইপ লাগিয়ে পড়েছে। এভাবেই নাজমা কলেজ পর্যন্ত তার পড়াশুনা শেষ করতে পেরেছে। নাজমা তখনো চাকরিতে ঢুকেনি। একদিন মাঝরাতে শমশের ঘরে ঢুকতেই ঝাঁপিয়ে পড়লো নাজমার উপর। তার শরীরে তখন এলকোহলের গন্ধ, সাথে গাঁজার ঝাঁজালো গন্ধে নাজমার বমি হবার যোগার হলো। এই গন্ধ নাজমা সয়ে আসছে সেই ছোটবেলা থেকে। বাবার গায়েও এমন গন্ধ থাকতো। কিন্তু মাকে কখনো নাজমা প্রতিক্রিয়া দেখাতে দেখেনি। তবে নাজমা মনে মনে ভীষণ রাগ করতো। মায়ের নীরবতা তাকে আরো বেশি হতাশ করতো। ধাক্কা দিয়ে নাজমা তাকে সরিয়ে দিলো। শমশের চিৎকার করে উঠলো। পাশেই শুয়ে ছিলো তাদের ছোট শিশুটি। সেও জেগে উঠলো, তাকিয়ে রইলো পিটপিট চোখে। শমশের তখন ইতিমধ্যেই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো। ক্রমাগত চঢ় কষতে লাগলো তার গালে, গায়ে। ছোট মেয়েটি তখন কাঁথা গায়ে মুখঢেকে থরথর করে কাঁপছিলো। এই প্রথম সেদিন নাজমা শমশেরকে থামাতে ধাক্কা মেরে খাট থেকে ফেলে দিলো। হঠাৎ করে ধাক্কা খেয়ে শমশের মেঝেতে পড়ে গেল। অতিমাত্রিক মাদক সেবনে আর উঠতে পারলো না। পরদিন সকাল পর্যন্ত মেঝেতেই পড়ে রইলো। এই প্রথম নাজমা প্রতিবাদ করতে শিখলো। আর সেটাই হলো কাল, অনিরাপত্তা ও হিংস্রতা বাড়িয়ে দিলো শমশের আলী ও তার পরিবারের। দিন দিন শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন বাড়তে লাগলো। একটা সময় নাজমা তার মেয়েকে নিয়ে ঘর ছাড়তে বাধ্য হলো। যখন নাজমা শমশের আলীকে তালাক দিতে সিদ্ধান্ত নিলো, তার বাবা বাধা দিলো। কিন্তু মা কিছুই বললো না। নাজমা অবাক হলো। জানতে চাইলো মায়ের নীরবতার কারণ। মা বললেন, “শোন নাজমা। আমি যা করতে পারিনাই, তুই তা করতে পারবি, কারণ তুই আইজ নিজেরে শিক্ষিত বানাইসোস।আইজ তুই ভালা একটা চাকরি কইরা নিজ পেট, নিজ সন্তানের পেট চালাইতে পারবি। নেশাখোর স্বোয়ামির লগে তোর ঘর করন লাগবো না। এই পুরুষগর দেমাগ কই জানোস? তাগর দেমাগ আসলে পুরুষ বইলা না, তাগর দেমাগ হইলো মাতব্বরিতে। এই যে পকেট থেইকা ট্যাকা বাইর কইরা সংসারে তেল, ন্যূন, চাল–ডাইল যোগান দেয়, হেইডাই তাগর দেমাগ। এই যোগান অহন তুইদিবি। হেরপর দেখ, তাগর দেমাগে কেমনে আগুন লাগে।” নাজমা বলেছিল, ‘মা। তুমি এতকিছু জানো, বুঝো, অথচ বেঁচে থেকেও তোমার নিজের জীবনের একটা দিন উপভোগ করতে পারলে না?’ মা তখন চোখ মুছতে মুছতে শুধু বলেছিল, ‘সুযোগ পাইনাই রে মা। আমার সুযোগ আছিল না।! আমি যা ঢোঁক গিলা হজম করসি, তুই হেইডা করবি না।‘ হ্যাঁ! নাজমা সেটা করেনি। নাজমা চায়নি তার শিশু মেয়েটি কাঁথার ভিতর মুখ লুকিয়ে চোখ পিটপিট করে মাঝরাতে ভয়ানক সব তান্ডব দেখুক। সে চায়নি শিশু মেয়েটি আতঙ্ক নিয়ে বেড়ে উঠুক, মানসিক সঙ্কটে পড়ুক। নাজমা চেয়েছে তার মেয়েটি একটা সুস্থ পরিবেশে বেড়ে উঠুক। একটা নিরাপদ পরিবেশে বেড়ে উঠুক। শমশের আলীর মা নাজমার দিকে তাকিয়ে তখনো চিৎকার করেই যাচ্ছেন…’যে স্বোয়ামি তোরে ভাত দিলো, কাপড় দিলো, জায়গা দিলো, পড়ার সুযোগ দিলো, তুই কিনা হেই স্বোয়ামির পিঠে লাথি মারলি? এ লো বেঈমানের বেটি নাজমা…………!’
টানাপোড়ন
ছেলেটা সেই কখন থেকে গাল ভার করে আছে বাবার কাছে যাবে বলে। আট বছরের ছেলেকে শায়লা কিভাবে বুঝায় যে, বাবাকে চাইলেই পাওয়া যাবে না! শায়লা পরম আদরে ছেলের মাথায় হাত রাখে, তার ভেতরটা কেঁদে উঠে। ছেলেকে ডাকে, -হামি -হুম। ঠোঁট ভেঙে হামি জবাব দেয়। -বাবা সামনের সপ্তাহে আসবে তোমাকে দেখতে -নাহ! আমি বাবাকে এখন দেখতে […]
Continue reading
Published by HB Rita on Saturday, September 21st, 2013