—গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি—
নহে মোর সাঁজানো কুটির,
নহে অধিকার।
সুন্দরের পূজারী আমি,
যবে ভবে অবতার।
একজন গীতিকার,সুরকার,নাট্যকার, মঞ্চ অভিনেতা, লেখক, রাজনীতিবিদ এবং একজম মুক্তিযোদ্ধা আমার বাবা সামসুদ্দীন আহমেদ এছাক। জীবনধর্মী বাস্তবতা নির্ভর সহজ সরল জীবন যাপনে অভ্যস্ত একজন মানুষ। ন্যায়নীতির ঊর্ধ্বে থেকে জীবনের পথ পাড়ি দেয়াদের একজন।
প্রকৃতিক সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেয়া কতটা সহজ তার জলজ্যান্ত প্রমান তিনি। ব্যতিক্রমধর্মী মনস্তাত্বিক জ্ঞ্যানের অধিকারী একজন সাধারন মানুষ ছিলেন আমার বাবা।
জীবন সম্পর্কে তাঁর সহজ সরল স্বীকারোক্তি মুলক বক্তব্য ছিল-
নদীরে তোর ভাটা দেখে
আমার প্রানে লাগে ভয়,
কোনদিন জানি তোরই মত
আমার গতি হয়।
জীবদ্দশায় বাবা অসংখ্য কবিতা, গল্প, গীতি নাট্য, প্রবন্ধ, নাটক ও গান রচনা করে গেছেন বিভিন্ন আঙ্গিকে। বাবার রচিতগানের মধ্যে নূর তত্ত্ব–সৃষ্টি, নবী তত্ত্ব, সাধন তত্ত্ব, প্রেম তত্ত্ব, মুর্শিদি, দেহতত্ত্ব, আত্মতত্ত্ব, ভাবতত্ত্ব, ভক্তিমূলক, আধুনিক, বিচ্ছেদ, দেশাত্মবোধক এবং বিবিধ পর্যায় উল্লেখযোগ্য। এসব গানের ভাব এবং তত্ত্ব স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল ও মহিমান্বিত। বাবার গানেকণ্ঠ দিয়েছিলেন দেশের খ্যাতমান শিল্পীবৃন্দ। তথ্য কাব্য এবং মরমি সঙ্গীত রচনা ছিল বাবার প্রিয়। তিনি ছিলেন বাংলাদেশটেলিভিশন এবং বেতারের তালিকাভূক্ত গীতিকার ও সুরকার। তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন প্রতিভা শিল্পী গোষ্ঠী। জীবনেরশেষকালে বাবা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘সামসুদ্দীন আহমেদ এছাক সংগীত একাডেমী।‘
ক্লাসিকাল বিদ্যার পাশাপাশি লোকসাহিত্য সংস্কৃতির যে সমৃদ্ধ সঞ্চয় ছিল নরসিংদীর পরিবেশে, তার পুরো উত্তরাধীকার গ্রহনেরক্ষমতা রেখেছেন আমার বাবা।
বাবা ছিলেন রাজনীতি প্রিয় একজন মানুষ। তবু অধ্যাত্ব সাধনা ও সাহিত্যচর্চা ছিল তাঁর অন্তরের বস্তু। তাঁর চিন্তা ভাবনা ছিললালনের চিন্তা ভাবনার অনুরুপ।
বাবা ছিলেন খুবই স্বাধীনচেতা, নৈতিক অহংবোধ একজন মানুষ। ক্ষমতার অপব্যবহার তিনি কখনো করেননি। অন্যায়ের সাথেআপোষ কখনো করেননি। নীতিতে ছিলেন কঠোর। বহু বছর আগের কথা। স্কুলে পড়া আমার শহীদ ভাইমাসুদ এবং জীবিত ভাই নাসির মজা করতে গিয়ে অন্যের গাছের নারিকেল চুরি করেছিলেন একদিন। সেই অপরাধে বাবা তাদেরদুই হাত বেঁধে চৈত্রের ক্ষরায় পাকা করা উঠোনে ফেলে রেখেছিলেন সারাদিন। প্রচন্ড তাপে তাদের শরীর জ্বলে উঠেছিল। বাবা তবুক্ষমা করেননি। অবশেষে দাদীমা অনুরোধ করে তার নাতীদের রক্ষা করেছিলেন। অবুঝ দুটি শিশুকে নারিকেল চুরির অপরাধেএমন শাস্তি, ছিল মর্মান্তিক। কিন্তু সেই মর্মান্তিক শাস্তির পর সে ভাইরা আর কোনদিন অন্যের সম্পদে হাত রাখেননি।
কত কি মনে পড়ে আজ!
কবির আহমেদ, আমার বড় ভাই মাত্র ১ নাম্বারের জন্য ঢাকাইফনিভার্সিটিতে ভর্তির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন। বাবা তখন সংসদ সদস্য। মন্ত্রীদের সাথে তার উঠা–বসা। পরিবারের শতঅনুরোধের পরও বাবা নিজ ছেলেকে ভর্তির জন্য কোন সুপারিশ করেননি ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে। তিনি বলেছিলেন, ‘আমিসুযোগের অসৎ ব্যবহার করবোনা।‘
আর বাবার সেই নৈতিক আদর্শে আমার ভাই পড়াশুনা থেকে এক বছর পিছিয়ে যান। পরের বছর নিজ যোগ্যতায় আবারো স্থানপান।
বাবাকে নিয়ে লিখতে গেলে কলমের কালি শেষ হয়ে যাবে। লিখা শেষ হবার নয়। বাবাকে নিয়ে রচিত ‘সামসুদ্দীন আহমেদএছাক‘র জীবন দর্শন ও রচনা নিদর্শন‘ গ্রন্থটিতে বাবার পুরো জীবন বৃত্তান্ত লিপিবদ্ধ করেছেন মুঃ নাছিবুর রহমান খান। বাবারসাহিত্য ও জীবন দর্শন নিয়ে কিছু তথ্য সেখান থেকে নেয়া।
কিছু কিছু মানুষের চলে যাওয়া মেনে নেয়া যায়না। ওরা চলে যায়। কিন্তু জীবনের কোথাও না কোথাও খুব নিখুঁত ভাবে ওরা সুক্ষ্ম ছাপ রেখে যায়। প্রতি মুহুর্তে মনে হয়, হৃদয়ের কোথায় যেন একটা ভীষণ শুন্যতা রয়ে গেছে। একটা যন্ত্রণাময় ফুটো তৈরী হয়েছে। আর সেই ফুটো দিয়ে, কোন এক অলুক্ষনে প্রহরে বিষাদ ঢুকে পরে হৃদয়ের ঠিক মধ্যিখানে, শুন্যস্থানে। জীবন যেন তখন আরো বিষময় হয়ে উঠে। অসহায়ত্ব ছেয়ে যায় সমস্ত অনুভুতিতে। মনে হয়, মানুষটা যদি আরো কিছুদিন থেকে যেত! যদি কোন এক অলৌকিক শক্তির বলে প্রিয় মানুষটি ফিরে আসতো!
জীবন কখনো আমায় হারাতে পারেনি। শুধু এই একটা জায়গায়, আমি অসহায়। আমি বিধ্বস্ত। ।
বাবাকে খুব বেশী মনে পরে। প্রতি মুহুর্তে মনে পরে। বাবা আমার এবং আমাদের জীবনের এক বিরাট শুন্যতা!
বাবার জন্য সকলের কাছে আমি দোয়া প্রার্থী।
শ্রদ্ধাজ্ঞাপনে,
এইচ বি রিতা
Post Views:
362
আমার বাবা
—গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি—
নহে মোর সাঁজানো কুটির,
নহে অধিকার।
সুন্দরের পূজারী আমি,
যবে ভবে অবতার।
একজন গীতিকার,সুরকার,নাট্যকার, মঞ্চ অভিনেতা, লেখক, রাজনীতিবিদ এবং একজম মুক্তিযোদ্ধা আমার বাবা সামসুদ্দীন আহমেদ এছাক। জীবনধর্মী বাস্তবতা নির্ভর সহজ সরল জীবন যাপনে অভ্যস্ত একজন মানুষ। ন্যায়নীতির ঊর্ধ্বে থেকে জীবনের পথ পাড়ি দেয়াদের একজন।
প্রকৃতিক সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেয়া কতটা সহজ তার জলজ্যান্ত প্রমান তিনি। ব্যতিক্রমধর্মী মনস্তাত্বিক জ্ঞ্যানের অধিকারী একজন সাধারন মানুষ ছিলেন আমার বাবা।
জীবন সম্পর্কে তাঁর সহজ সরল স্বীকারোক্তি মুলক বক্তব্য ছিল-
নদীরে তোর ভাটা দেখে
আমার প্রানে লাগে ভয়,
কোনদিন জানি তোরই মত
আমার গতি হয়।
জীবদ্দশায় বাবা অসংখ্য কবিতা, গল্প, গীতি নাট্য, প্রবন্ধ, নাটক ও গান রচনা করে গেছেন বিভিন্ন আঙ্গিকে। বাবার রচিতগানের মধ্যে নূর তত্ত্ব–সৃষ্টি, নবী তত্ত্ব, সাধন তত্ত্ব, প্রেম তত্ত্ব, মুর্শিদি, দেহতত্ত্ব, আত্মতত্ত্ব, ভাবতত্ত্ব, ভক্তিমূলক, আধুনিক, বিচ্ছেদ, দেশাত্মবোধক এবং বিবিধ পর্যায় উল্লেখযোগ্য। এসব গানের ভাব এবং তত্ত্ব স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল ও মহিমান্বিত। বাবার গানেকণ্ঠ দিয়েছিলেন দেশের খ্যাতমান শিল্পীবৃন্দ। তথ্য কাব্য এবং মরমি সঙ্গীত রচনা ছিল বাবার প্রিয়। তিনি ছিলেন বাংলাদেশটেলিভিশন এবং বেতারের তালিকাভূক্ত গীতিকার ও সুরকার। তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন প্রতিভা শিল্পী গোষ্ঠী। জীবনেরশেষকালে বাবা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘সামসুদ্দীন আহমেদ এছাক সংগীত একাডেমী।‘
ক্লাসিকাল বিদ্যার পাশাপাশি লোকসাহিত্য সংস্কৃতির যে সমৃদ্ধ সঞ্চয় ছিল নরসিংদীর পরিবেশে, তার পুরো উত্তরাধীকার গ্রহনেরক্ষমতা রেখেছেন আমার বাবা।
বাবা ছিলেন রাজনীতি প্রিয় একজন মানুষ। তবু অধ্যাত্ব সাধনা ও সাহিত্যচর্চা ছিল তাঁর অন্তরের বস্তু। তাঁর চিন্তা ভাবনা ছিললালনের চিন্তা ভাবনার অনুরুপ।
বাবা ছিলেন খুবই স্বাধীনচেতা, নৈতিক অহংবোধ একজন মানুষ। ক্ষমতার অপব্যবহার তিনি কখনো করেননি। অন্যায়ের সাথেআপোষ কখনো করেননি। নীতিতে ছিলেন কঠোর। বহু বছর আগের কথা। স্কুলে পড়া আমার শহীদ ভাইমাসুদ এবং জীবিত ভাই নাসির মজা করতে গিয়ে অন্যের গাছের নারিকেল চুরি করেছিলেন একদিন। সেই অপরাধে বাবা তাদেরদুই হাত বেঁধে চৈত্রের ক্ষরায় পাকা করা উঠোনে ফেলে রেখেছিলেন সারাদিন। প্রচন্ড তাপে তাদের শরীর জ্বলে উঠেছিল। বাবা তবুক্ষমা করেননি। অবশেষে দাদীমা অনুরোধ করে তার নাতীদের রক্ষা করেছিলেন। অবুঝ দুটি শিশুকে নারিকেল চুরির অপরাধেএমন শাস্তি, ছিল মর্মান্তিক। কিন্তু সেই মর্মান্তিক শাস্তির পর সে ভাইরা আর কোনদিন অন্যের সম্পদে হাত রাখেননি।
কত কি মনে পড়ে আজ!
কবির আহমেদ, আমার বড় ভাই মাত্র ১ নাম্বারের জন্য ঢাকাইফনিভার্সিটিতে ভর্তির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন। বাবা তখন সংসদ সদস্য। মন্ত্রীদের সাথে তার উঠা–বসা। পরিবারের শতঅনুরোধের পরও বাবা নিজ ছেলেকে ভর্তির জন্য কোন সুপারিশ করেননি ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে। তিনি বলেছিলেন, ‘আমিসুযোগের অসৎ ব্যবহার করবোনা।‘
আর বাবার সেই নৈতিক আদর্শে আমার ভাই পড়াশুনা থেকে এক বছর পিছিয়ে যান। পরের বছর নিজ যোগ্যতায় আবারো স্থানপান।
বাবাকে নিয়ে লিখতে গেলে কলমের কালি শেষ হয়ে যাবে। লিখা শেষ হবার নয়। বাবাকে নিয়ে রচিত ‘সামসুদ্দীন আহমেদএছাক‘র জীবন দর্শন ও রচনা নিদর্শন‘ গ্রন্থটিতে বাবার পুরো জীবন বৃত্তান্ত লিপিবদ্ধ করেছেন মুঃ নাছিবুর রহমান খান। বাবারসাহিত্য ও জীবন দর্শন নিয়ে কিছু তথ্য সেখান থেকে নেয়া।
কিছু কিছু মানুষের চলে যাওয়া মেনে নেয়া যায়না। ওরা চলে যায়। কিন্তু জীবনের কোথাও না কোথাও খুব নিখুঁত ভাবে ওরা সুক্ষ্ম ছাপ রেখে যায়। প্রতি মুহুর্তে মনে হয়, হৃদয়ের কোথায় যেন একটা ভীষণ শুন্যতা রয়ে গেছে। একটা যন্ত্রণাময় ফুটো তৈরী হয়েছে। আর সেই ফুটো দিয়ে, কোন এক অলুক্ষনে প্রহরে বিষাদ ঢুকে পরে হৃদয়ের ঠিক মধ্যিখানে, শুন্যস্থানে। জীবন যেন তখন আরো বিষময় হয়ে উঠে। অসহায়ত্ব ছেয়ে যায় সমস্ত অনুভুতিতে। মনে হয়, মানুষটা যদি আরো কিছুদিন থেকে যেত! যদি কোন এক অলৌকিক শক্তির বলে প্রিয় মানুষটি ফিরে আসতো!
জীবন কখনো আমায় হারাতে পারেনি। শুধু এই একটা জায়গায়, আমি অসহায়। আমি বিধ্বস্ত। ।
বাবাকে খুব বেশী মনে পরে। প্রতি মুহুর্তে মনে পরে। বাবা আমার এবং আমাদের জীবনের এক বিরাট শুন্যতা!
বাবার জন্য সকলের কাছে আমি দোয়া প্রার্থী।
Published by HB Rita on Saturday, January 31st, 2015