
যদিও বেশিরভাগ ইউরোপীয় চিন্তাবিদ এবং দার্শনিকরাই বিখ্যাত, তবে কার্ল মার্ক্সের মতো এঁরা সকলেই প্রাসঙ্গিক নন, যাকে প্রায়শই বিপ্লবের জনক হিসাবে উল্লেখ করা হয়।
আজ ১৪ মার্চ, ঊনবিংশ শতকের শ্রেষ্ঠ দার্শনিক, মার্ক্সবাদের প্রবক্তা কার্ল মার্ক্স-এর ১৩৯তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৮১৮ সালের ৫ই মে জার্মান এর , তৎকালীন প্রাশিয়ার ত্রিভস (ত্রিয়্যার) শহরে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তিনি ছিলেন একজন অর্থনীতিবিদ, ইতিহাসবেত্তা, সমাজ বিজ্ঞানী, রাজনৈতিক তাত্ত্বিক, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবী, সমগ্র মানব ইতিহাসের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বদের একজন।
জীবিত অবস্থায় সেভাবে পরিচিত না হলেও মৃত্যুর পর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেন জার্মান সমাজ বিজ্ঞানী ও মার্ক্সবাদের প্রবক্তা কার্ল হাইনরিশ মার্ক্স (জার্মান-Karl Heinrich Marx)।
মার্কসবাদ দর্শন ধনী শ্রেণীর মানুষকে পেরিয়ে নিন্ম স্তরের শোষিত মানুষের জন্য তৈরি করা হয়েছিলো।ঊনবিংশ শতাব্দীর দার্শনিক, অর্থনীতিবিদ, সাংবাদিক এবং বিপ্লবী কার্ল মার্ক্স ও ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস্ সমাজ, অর্থনীতি, ও রাজনীতিসংক্রান্ত তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক অনুশীলন ও সামাজিক তত্বই হল মার্ক্সবাদ। মার্ক্সের গুরুত্বপূর্ণ রচনাগুলোর মাঝে রয়েছে ‘পুঁজি’ (তিন খণ্ডে রচিত), ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসের সাথে যৌথভাবে রচিত ‘কমিউনিষ্ট ইশতেহার'(১৮৪৮).
মার্ক্স তাঁর প্রাথমিক জীবন কাটান প্রাশিয়ার ট্রিয়ারে। সেখানে হাইনরিশ এবং হেনরিটা মার্ক্সের নয় সন্তানের মধ্যে একজন ছিলেন কার্ল হাইনরিশ মার্ক্স। তাঁর বাবা একজন সফল আইনজীবী ছিলেন যিনি প্রাশিয়ান সংস্কারের একজন অনুরাগী কর্মী। যদিও তাঁর পিতা-মাতা উভয়ই রাব্বিনিকাল বংশের ইহুদি ছিলেন, তবে মার্ক্সের বাবা ৩৫ বছর বয়সে ১৮১৬ সালে খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হন এবং লুথারীয় মতবাদে দীক্ষা নেন। সে সময়
লুথারীয় ধর্ম প্রাশিয় সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রীয় প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্ম ছিল। ধারণা করা হয়, ১৮১৫ সালের উচ্চ সমাজ থেকে ইহুদিদের নিষিদ্ধ করার আইনের প্রতিক্রিয়া হিসাবে
রোমান ক্যাথলিক সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রে লুথারীয় সংখ্যালঘু হিসেবে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা লাভের আশায় তিনি ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন।
পড়াশুনায় অসাধারণ মেধাবী মার্ক্স ১২ বছর বয়স পর্যন্ত বাড়িতে পড়াশোনা করেছিলেন। ১৮৩০ থেকে ১৮৩৫ মোট ৫ বছর তিনি ট্রিয়ারের জেসুইট উচ্চ বিদ্যালয়ে অতিবাহিত করেন। এই সময় এটা ফ্রেডরিচ-উইলহেলম গিমনেজিউম নামে পরিচিত ছিল। বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ, মার্ক্সের পিতার বন্ধু ছিলেন একজন উদার এবং কান্তিয়ান লোক যিনি রাইনল্যান্ডের লোকদের কাছে সন্দেহজনক ছিলেন বিধায় বিদ্যালয়টি নজরদারিতে ছিল। এবং ১৮৩২ সালে বিদ্যালয়টিতে অভিযান চালানো হয়েছিল।
১৮৩৫ সালের অক্টোবরে মার্ক্স বন -এ পড়াশোনা শুরু করেন। এটি একটি প্রাণবন্ত এবং বিদ্রোহী সংস্কৃতি ছিল এবং মার্ক্স উৎসাহের সাথে ছাত্রজীবনে অংশ নিয়েছিল। সেখানে তার দুটি সেমিস্টারে পর শান্তি বিঘ্নিত করার অভিযোগে কারা বরণ করেন তিনি। বছরের শেষে, বাবার জোরে মার্ক্স বার্লিনের আরেকটি উন্নত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। বার্লিনে তিনি আইন এবং দর্শন বিষয়ে অধ্যয়ন শুরু করেন। সেখানে তিনি জি.ডব্লিউএফ হেগেল দর্শনের সাথে পরিচিত হন, যিনি ১৮৩১ সাল তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বার্লিনে অধ্যাপক ছিলেন।
মার্ক্স প্রথমে হেগেলের প্রতি অনুরাগী না হলেও দ্রুত তিনি ইয়াং হেগেলিয়ানদের সাথে যুক্ত হন এবং আর্থ-রাজনৈতিক তত্ত্বগুলির অনুসন্ধান শুরু করেন। ইয়াং হেগেলিয়ান ছিল ব্রুনো বাউর এবং লাডউইচ ফেউয়ারবাচ সহ অনন্য ছাত্রদের একটি উগ্রপন্থী দল, যারা রাজনৈতিক সমালোচনা করতেন এবং দিনের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠায় তৎপর ছিলেন।
১৮৩৬ সালে মার্ক্স যখন রাজনৈতিকভাবে আরও বেশি উদ্যোগী হয়ে উঠছিলেন, সে সময় গোপনে জেনি ভন ভেস্টফেলেন এর সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। ভেস্টফেলেন তার থেকে বয়সে চার বছরের জ্যেষ্ঠ ছিলেন এবং তিনি ছিলেন ট্রায়ারের এক সম্মানিত পরিবারের একজন অন্বেষী মহিলা।
বিষয়টি মার্ক্স এর ক্রমবর্ধমান উগ্রপন্থার সাথে তার পিতাকে আরো রাগিয়ে দেয়। একাধিক চিঠিতে মার্ক্সের বাবা তাঁর ছেলেকে সতর্ক করেন যেন বিবাহের দায়িত্বগুলি যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে যেন না নেওয়া হয়। তিনি সন্তানের তৎকালিন পদক্ষেপগুলোকে ‘ডেমন’ হিসাবে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
মার্ক্স ১৮৪১ সালে জেনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। তবে তাঁর উগ্র রাজনীতি তাকে পাঠদানের পদে যেতে বাধা দেয়। তখন তিনি সাংবাদিক হিসাবে কাজ শুরু করেন এবং ১৮৪২ সালে তিনি কোলোনে একটি উদার সংবাদপত্র রাইনিশে ছাইটুং -এর সম্পাদক হন। সম্পাদক হিসাবে যোগ দেয়ার পর থেকেই মার্ক্স-এর ক্ষুরধার লেখনীর জোড়ে কাগজের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর উত্তর উত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। এরপর কয়েক মাসের মধ্যেই সরকারি রোষানলে পড়ে কাগজের অফিসটি বন্ধ করার নির্দেশ আসে যা এপ্রিল ১, ১৮৪৩ তে কার্যকর হয়। ইতিমধ্যেই মার্ক্স ১৮ই মার্চ পদত্যাগ করেন। এই সময় মার্ক্স অর্থশাস্ত্রের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং তার পাঠ নেয়া শুরু করেন।
১৮৪৩ সালের ১৯-এ জুন জেনির সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হন মার্ক্স। এবং অক্টোবরে তারা প্যারিসে চলে যান। সেখান থেকে নির্বাসিত হন লন্ডনে। বাকি জীবন তাদের সেখানেই কাটে।
১৮৪৩ সালে প্যারিস ছিল ইউরোপের রাজনৈতিক প্রাণকেন্দ্র। সেখানে আর্নল্ড রুজকে সাথে নিয়ে মার্ক্স ডয়েশে ফ্রানছ্যোজিশে ইয়ারব্যুখার(Deutsch-Französische Jahrbücher) নামে একটি রাজনৈতিক জার্নাল প্রতিষ্ঠা করেন। সে সময় ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস্ প্যারিসে গিয়েছিলেন মার্ক্সকে ইংল্যান্ডে কর্মজীবী মানুষের অবস্থা সম্পর্কে জানাতে। সে পরিচয়ের ভিত্তিতেই ১৮৪৪ সালে মার্ক্স ও এঙ্গেল্স এর মধ্যে বন্ধুত্ব জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা ঘটে। দুজনে মিলে এক তরুণ হেজেলিয়ান এবং মার্ক্সের প্রাক্তন বন্ধু ব্রুনো বাউয়ের দর্শনের সমালোচনায় লিখতে শুরু করেন। মার্ক্স এবং এঙ্গেলসের প্রথম সহযোগিতায় লিখাটি ১৮৪৫ সালে ‘দ্য হোলি ফ্যামিলি’ হিসাবে প্রকাশিত হয়। বছরের পরের দিকে, অন্য একটি উগ্রপন্থী সংবাদপত্র, ভরওয়ার্টস (জার্মানি-Vorwärts/ইংলিশ-ফর্ওয়ার্ডস) পক্ষে লেখার কারণে যা পরবর্তীকালে কমিউনিস্ট লিগে পরিণত হয়, ফ্রান্স থেকে বহিষ্কার হন মার্ক্স। পরে তিনি বেলজিয়ামে চলে আসেন।
১৮৪৮ সালে জার্মানি এবং অস্ট্রিয়াতে বুর্জোয়া বিপ্লব শুরু হলে মার্কসকে বেলজিয়াম থেকে বিতাড়িত করা হয়। মার্ক্স চলে যান প্যারিসে। সেখান থেকে আবারও নির্বাসিত হন তিনি লন্ডনে।
১৮৪৯ সালের মে মাসে কার্ল মার্ক্স লন্ডন পাড়ি দেন এবং ব্রিটেনে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। ১৮৫১ সালে তিনি নিউইয়র্ক ট্রিবিউন এর স্থানীয় সংবাদদাতা হিসেবে কাজ শুরু করেন। সেখানেই তিনি বাকি জীবন পাড়ি দেন।
জীবনের শেষ দশকে তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে। প্রত্যয়ী বুদ্ধবৃত্তিক আন্দোলন পরিচালনায় অক্ষম হয়ে পড়েন। তবে সমসাময়িক রাজনীতি, বিশেষ করে জার্মানি ও রাশিয়ার রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে কখনই বিরত ছিলেন না।
প্রায় ১৫ মাস দুরারোগ্য ব্যাধীতে ভুগে ১৮৮৩ সালের ১৪ মার্চ লন্ডনে মৃত্যু বরণ করা এই মহান শিক্ষাগুরুর মূলত নিজের কোন দেশ ছিলনা। তাঁর মৃত্যু পরবর্তীকালে শোক জানানোর জন্যও জড় হয়েছিল কম সংখ্যক মানুষ। তাঁর মৃত্যুর অনেক পরে বিশেষত রাশিয়াতে শ্রমিক শ্রেণির বলশেভিক পার্টি ক্ষমতায় আসার পর বিশ্বে নতুন এক সমাজতান্ত্রিক দেশের অভ্যুদয় ঘটে। আর তারপরই বিশ্ব নতুন করে কার্ল মার্ক্সকে জানতে শুরু করেন।
কার্ল মার্ক্স স্মরণ অনুষ্ঠানে বন্ধু ফ্রেডরিক এঙ্গেলস বলেছিলেন, “১৪ মার্চ বিকেল ঠিক পৌণে তিনটায় বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ট জীবিত চিন্তাবিদ চিন্তা থেকে বিরত হয়েছেন । মাত্র মিনিট দুয়েকের জন্যে তাঁকে একা রেখে অন্যত্র গিয়েছিলাম আমরা । ফিরে এসে দেখলাম, নিজস্ব আর্মচেয়ারটাতে শান্তিতে ঘুমিয়ে আছেন তিনি, ঘুমিয়ে আছেন চিরদিনের মতো।”
আজ তাকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি আমরা।
Post Views:
342
সাহিত্য শ্রদ্ধায় স্মরণ করি তোমায় কার্ল মার্ক্স
যদিও বেশিরভাগ ইউরোপীয় চিন্তাবিদ এবং দার্শনিকরাই বিখ্যাত, তবে কার্ল মার্ক্সের মতো এঁরা সকলেই প্রাসঙ্গিক নন, যাকে প্রায়শই বিপ্লবের জনক হিসাবে উল্লেখ করা হয়।
আজ ১৪ মার্চ, ঊনবিংশ শতকের শ্রেষ্ঠ দার্শনিক, মার্ক্সবাদের প্রবক্তা কার্ল মার্ক্স-এর ১৩৯তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৮১৮ সালের ৫ই মে জার্মান এর , তৎকালীন প্রাশিয়ার ত্রিভস (ত্রিয়্যার) শহরে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তিনি ছিলেন একজন অর্থনীতিবিদ, ইতিহাসবেত্তা, সমাজ বিজ্ঞানী, রাজনৈতিক তাত্ত্বিক, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবী, সমগ্র মানব ইতিহাসের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বদের একজন।
জীবিত অবস্থায় সেভাবে পরিচিত না হলেও মৃত্যুর পর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেন জার্মান সমাজ বিজ্ঞানী ও মার্ক্সবাদের প্রবক্তা কার্ল হাইনরিশ মার্ক্স (জার্মান-Karl Heinrich Marx)।
মার্কসবাদ দর্শন ধনী শ্রেণীর মানুষকে পেরিয়ে নিন্ম স্তরের শোষিত মানুষের জন্য তৈরি করা হয়েছিলো।ঊনবিংশ শতাব্দীর দার্শনিক, অর্থনীতিবিদ, সাংবাদিক এবং বিপ্লবী কার্ল মার্ক্স ও ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস্ সমাজ, অর্থনীতি, ও রাজনীতিসংক্রান্ত তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক অনুশীলন ও সামাজিক তত্বই হল মার্ক্সবাদ। মার্ক্সের গুরুত্বপূর্ণ রচনাগুলোর মাঝে রয়েছে ‘পুঁজি’ (তিন খণ্ডে রচিত), ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসের সাথে যৌথভাবে রচিত ‘কমিউনিষ্ট ইশতেহার'(১৮৪৮).
মার্ক্স তাঁর প্রাথমিক জীবন কাটান প্রাশিয়ার ট্রিয়ারে। সেখানে হাইনরিশ এবং হেনরিটা মার্ক্সের নয় সন্তানের মধ্যে একজন ছিলেন কার্ল হাইনরিশ মার্ক্স। তাঁর বাবা একজন সফল আইনজীবী ছিলেন যিনি প্রাশিয়ান সংস্কারের একজন অনুরাগী কর্মী। যদিও তাঁর পিতা-মাতা উভয়ই রাব্বিনিকাল বংশের ইহুদি ছিলেন, তবে মার্ক্সের বাবা ৩৫ বছর বয়সে ১৮১৬ সালে খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হন এবং লুথারীয় মতবাদে দীক্ষা নেন। সে সময়
লুথারীয় ধর্ম প্রাশিয় সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রীয় প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্ম ছিল। ধারণা করা হয়, ১৮১৫ সালের উচ্চ সমাজ থেকে ইহুদিদের নিষিদ্ধ করার আইনের প্রতিক্রিয়া হিসাবে
রোমান ক্যাথলিক সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রে লুথারীয় সংখ্যালঘু হিসেবে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা লাভের আশায় তিনি ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন।
পড়াশুনায় অসাধারণ মেধাবী মার্ক্স ১২ বছর বয়স পর্যন্ত বাড়িতে পড়াশোনা করেছিলেন। ১৮৩০ থেকে ১৮৩৫ মোট ৫ বছর তিনি ট্রিয়ারের জেসুইট উচ্চ বিদ্যালয়ে অতিবাহিত করেন। এই সময় এটা ফ্রেডরিচ-উইলহেলম গিমনেজিউম নামে পরিচিত ছিল। বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ, মার্ক্সের পিতার বন্ধু ছিলেন একজন উদার এবং কান্তিয়ান লোক যিনি রাইনল্যান্ডের লোকদের কাছে সন্দেহজনক ছিলেন বিধায় বিদ্যালয়টি নজরদারিতে ছিল। এবং ১৮৩২ সালে বিদ্যালয়টিতে অভিযান চালানো হয়েছিল।
১৮৩৫ সালের অক্টোবরে মার্ক্স বন -এ পড়াশোনা শুরু করেন। এটি একটি প্রাণবন্ত এবং বিদ্রোহী সংস্কৃতি ছিল এবং মার্ক্স উৎসাহের সাথে ছাত্রজীবনে অংশ নিয়েছিল। সেখানে তার দুটি সেমিস্টারে পর শান্তি বিঘ্নিত করার অভিযোগে কারা বরণ করেন তিনি। বছরের শেষে, বাবার জোরে মার্ক্স বার্লিনের আরেকটি উন্নত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। বার্লিনে তিনি আইন এবং দর্শন বিষয়ে অধ্যয়ন শুরু করেন। সেখানে তিনি জি.ডব্লিউএফ হেগেল দর্শনের সাথে পরিচিত হন, যিনি ১৮৩১ সাল তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বার্লিনে অধ্যাপক ছিলেন।
মার্ক্স প্রথমে হেগেলের প্রতি অনুরাগী না হলেও দ্রুত তিনি ইয়াং হেগেলিয়ানদের সাথে যুক্ত হন এবং আর্থ-রাজনৈতিক তত্ত্বগুলির অনুসন্ধান শুরু করেন। ইয়াং হেগেলিয়ান ছিল ব্রুনো বাউর এবং লাডউইচ ফেউয়ারবাচ সহ অনন্য ছাত্রদের একটি উগ্রপন্থী দল, যারা রাজনৈতিক সমালোচনা করতেন এবং দিনের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠায় তৎপর ছিলেন।
১৮৩৬ সালে মার্ক্স যখন রাজনৈতিকভাবে আরও বেশি উদ্যোগী হয়ে উঠছিলেন, সে সময় গোপনে জেনি ভন ভেস্টফেলেন এর সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। ভেস্টফেলেন তার থেকে বয়সে চার বছরের জ্যেষ্ঠ ছিলেন এবং তিনি ছিলেন ট্রায়ারের এক সম্মানিত পরিবারের একজন অন্বেষী মহিলা।
বিষয়টি মার্ক্স এর ক্রমবর্ধমান উগ্রপন্থার সাথে তার পিতাকে আরো রাগিয়ে দেয়। একাধিক চিঠিতে মার্ক্সের বাবা তাঁর ছেলেকে সতর্ক করেন যেন বিবাহের দায়িত্বগুলি যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে যেন না নেওয়া হয়। তিনি সন্তানের তৎকালিন পদক্ষেপগুলোকে ‘ডেমন’ হিসাবে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
মার্ক্স ১৮৪১ সালে জেনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। তবে তাঁর উগ্র রাজনীতি তাকে পাঠদানের পদে যেতে বাধা দেয়। তখন তিনি সাংবাদিক হিসাবে কাজ শুরু করেন এবং ১৮৪২ সালে তিনি কোলোনে একটি উদার সংবাদপত্র রাইনিশে ছাইটুং -এর সম্পাদক হন। সম্পাদক হিসাবে যোগ দেয়ার পর থেকেই মার্ক্স-এর ক্ষুরধার লেখনীর জোড়ে কাগজের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর উত্তর উত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। এরপর কয়েক মাসের মধ্যেই সরকারি রোষানলে পড়ে কাগজের অফিসটি বন্ধ করার নির্দেশ আসে যা এপ্রিল ১, ১৮৪৩ তে কার্যকর হয়। ইতিমধ্যেই মার্ক্স ১৮ই মার্চ পদত্যাগ করেন। এই সময় মার্ক্স অর্থশাস্ত্রের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং তার পাঠ নেয়া শুরু করেন।
১৮৪৩ সালের ১৯-এ জুন জেনির সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হন মার্ক্স। এবং অক্টোবরে তারা প্যারিসে চলে যান। সেখান থেকে নির্বাসিত হন লন্ডনে। বাকি জীবন তাদের সেখানেই কাটে।
১৮৪৩ সালে প্যারিস ছিল ইউরোপের রাজনৈতিক প্রাণকেন্দ্র। সেখানে আর্নল্ড রুজকে সাথে নিয়ে মার্ক্স ডয়েশে ফ্রানছ্যোজিশে ইয়ারব্যুখার(Deutsch-Französische Jahrbücher) নামে একটি রাজনৈতিক জার্নাল প্রতিষ্ঠা করেন। সে সময় ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস্ প্যারিসে গিয়েছিলেন মার্ক্সকে ইংল্যান্ডে কর্মজীবী মানুষের অবস্থা সম্পর্কে জানাতে। সে পরিচয়ের ভিত্তিতেই ১৮৪৪ সালে মার্ক্স ও এঙ্গেল্স এর মধ্যে বন্ধুত্ব জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা ঘটে। দুজনে মিলে এক তরুণ হেজেলিয়ান এবং মার্ক্সের প্রাক্তন বন্ধু ব্রুনো বাউয়ের দর্শনের সমালোচনায় লিখতে শুরু করেন। মার্ক্স এবং এঙ্গেলসের প্রথম সহযোগিতায় লিখাটি ১৮৪৫ সালে ‘দ্য হোলি ফ্যামিলি’ হিসাবে প্রকাশিত হয়। বছরের পরের দিকে, অন্য একটি উগ্রপন্থী সংবাদপত্র, ভরওয়ার্টস (জার্মানি-Vorwärts/ইংলিশ-ফর্ওয়ার্ডস) পক্ষে লেখার কারণে যা পরবর্তীকালে কমিউনিস্ট লিগে পরিণত হয়, ফ্রান্স থেকে বহিষ্কার হন মার্ক্স। পরে তিনি বেলজিয়ামে চলে আসেন।
১৮৪৮ সালে জার্মানি এবং অস্ট্রিয়াতে বুর্জোয়া বিপ্লব শুরু হলে মার্কসকে বেলজিয়াম থেকে বিতাড়িত করা হয়। মার্ক্স চলে যান প্যারিসে। সেখান থেকে আবারও নির্বাসিত হন তিনি লন্ডনে।
১৮৪৯ সালের মে মাসে কার্ল মার্ক্স লন্ডন পাড়ি দেন এবং ব্রিটেনে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। ১৮৫১ সালে তিনি নিউইয়র্ক ট্রিবিউন এর স্থানীয় সংবাদদাতা হিসেবে কাজ শুরু করেন। সেখানেই তিনি বাকি জীবন পাড়ি দেন।
জীবনের শেষ দশকে তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে। প্রত্যয়ী বুদ্ধবৃত্তিক আন্দোলন পরিচালনায় অক্ষম হয়ে পড়েন। তবে সমসাময়িক রাজনীতি, বিশেষ করে জার্মানি ও রাশিয়ার রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে কখনই বিরত ছিলেন না।
প্রায় ১৫ মাস দুরারোগ্য ব্যাধীতে ভুগে ১৮৮৩ সালের ১৪ মার্চ লন্ডনে মৃত্যু বরণ করা এই মহান শিক্ষাগুরুর মূলত নিজের কোন দেশ ছিলনা। তাঁর মৃত্যু পরবর্তীকালে শোক জানানোর জন্যও জড় হয়েছিল কম সংখ্যক মানুষ। তাঁর মৃত্যুর অনেক পরে বিশেষত রাশিয়াতে শ্রমিক শ্রেণির বলশেভিক পার্টি ক্ষমতায় আসার পর বিশ্বে নতুন এক সমাজতান্ত্রিক দেশের অভ্যুদয় ঘটে। আর তারপরই বিশ্ব নতুন করে কার্ল মার্ক্সকে জানতে শুরু করেন।
কার্ল মার্ক্স স্মরণ অনুষ্ঠানে বন্ধু ফ্রেডরিক এঙ্গেলস বলেছিলেন, “১৪ মার্চ বিকেল ঠিক পৌণে তিনটায় বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ট জীবিত চিন্তাবিদ চিন্তা থেকে বিরত হয়েছেন । মাত্র মিনিট দুয়েকের জন্যে তাঁকে একা রেখে অন্যত্র গিয়েছিলাম আমরা । ফিরে এসে দেখলাম, নিজস্ব আর্মচেয়ারটাতে শান্তিতে ঘুমিয়ে আছেন তিনি, ঘুমিয়ে আছেন চিরদিনের মতো।”
আজ তাকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি আমরা।
Published by HB Rita on Thursday, March 14th, 2019