সন্তান কতটা ধারণ করতে পারে তা দেখুন

ব্রুকলিন টেক, ব্রংক্স সাইন্স, লেহমান কলেজ, কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়…..ইত্যাদি স্কুল কলেজগুলোতে আমাদের সন্তানদের পড়তেই হবে কেন? না পড়লে কি আমাদের সন্তানরা মানুষ বলে বিবেচিত হবে না?
বিষয়টা এমন যেন, বিশেষ স্কুল-কলেজগুলোতে না পড়তে পারলে অন্যের কাছে আমাদের সম্মান ক্ষুণ্ণ হবে।
সর্বোচ্চ ফলাফল নিয়ে উন্নত হাইস্কুল, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার এই প্রতিযোগীতা আমেরিকায় নিজ বাঙালি কমিউনিটির মধ্যে বেশ লক্ষনীয়।
দেশের কথা বলতে গেলে, একটা সময় ঘরের বাইরে ব্যয়বহুল টিউটোরিয়ালের খুব বেশি আবির্ভাব ছিলনা। যা ছিল তা ঘরের ভিতর দক্ষ-অদক্ষ গৃহশিক্ষকের মাধ্যমেই শেখার ছিল। মূলত Tutor শব্দটা থেকে Tutorial শব্দটা এসেছে। Tutor শব্দের একাধিক অর্থের একটি হল- গৃহশিক্ষক। আবার Tutor শব্দের Verb হিসাবে অর্থ হবে-পড়ানো বা শিখানো।
বর্তমানে বহির্বিশ্বের সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে, বাংলাদেশের শিক্ষা বিভাগের কারিকিউলাম সহ শিক্ষা ব্যবস্থার অনেক কিছুই বদলেছে। সেই সাথে চলছে সর্বোচ্চ গ্রেড পাওয়ার প্রতিযোগীতা।
আমাদের প্রায় সব পিতা-মাতারাই চান তাদের সন্তানেরা ভাল ফলাফলে উন্নত রেংকিং এর কোন হাইস্কুল, কলেজে পড়বে। ভালভাবে পাস করে বের হয়ে বিশেষ কেউ হবে, উন্নত চাকরিতে ভাল উপার্জন করবে, স্বাচ্ছন্দময় একটা জীবন উপভোগ করবে।
কিন্তু সব বা সবার সন্তানেরা শুধুমাত্র নিজ প্রচেষ্টায় ভাল ফলাফল তুলতে পারেন না। আর তখনই বাবা-মায়েরা খুঁজে বের করেন বিভিন্ন টিউটোরিয়াল একাডেমিক প্রতিষ্ঠানগুলো, যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল, বিশেষ করে নিন্মবিত্ত, মধ্যবত্তের জন্য। মূলত এলিমেন্টারি, জুনিয়র হাইস্কুল থেকেই শুরু হয় বাবা-মায়েদের এই প্রতিযোগীতায় সন্তানকে আটকে দেয়ার চেষ্টা।
এবং কষ্ট করে অর্থ ব্যয়ে সন্তানদের বিভিন্ন টিউটোরিয়ালে ভর্তি করানোর পরও যখন আমাদের সন্তানেরা আশানুরূপ ফলাফল তুলতে ব্যর্থ হয়, এবং নামকরা স্কুল-কলেজে ভর্তি হওয়ার সুযোগ না পায়, তখন আমরা বাবা-মায়েরা হতাশ হই। আমরা সন্তানের উপর মেজাজ দেখাই, আমরা টিউটোরিয়ালগুলোকে দোষারুপ করতে শুরু করি।
সাধারণত টিউটোরিয়াল বা একাডেমিগুলোতে শিক্ষার্থীদের তাদের যোগ্যতার প্রমাণ দিতে পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয়। তারপর হয়তো শিক্ষার্থীদের পিছিয়ে থাকা প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোর উপর উন্নতি সাধনে সাহায্য করা হয়। আমি খুব সম্পুর্রভাবে তাদের সিস্টেম সম্পর্কে অবগত নই।
যাই হোক, টিউটোরিয়াল বা বিভিন্ন একাডেমি প্রতিষ্ঠানগুলো বিনামূল্যে কোন সহায়তা করা হয়না, অর্থের বিনিময়েই শিক্ষা প্রদান করা হয়। সেটাও অনেক ক্ষেত্রে প্যাকেজ অনুযায়ী মূল্য। কাজেই তাদেরকে শুধু ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠান’ বলা যায় না, ‘ব্যবসা প্রতিষ্ঠান’ ও বলতে পারি। আরো একটা বিষয় বাবা-মা হিসাবে আমাদের জেনে রাখা দরকার যে, বিভিন্ন শিক্ষামূলক টিউটোরিয়াল বা কুচিং সেন্টারগুলো কিন্তু আপনার সন্তানের শেখায় প্রোগ্রেস বা উন্নতি টানতে সাহায্য করবে, কিন্তু, সন্তানের ধারণকৃত আকর্ষণ-মেধাকে পরিবর্তন ঘটাতে পারবে না। আপনি নিজেও পারবেন না। কাজেই বাবা-মা হিসাবে আপনার নয়; সন্তানের আগ্রহ, আকর্ষণ, ধারণ ক্ষমতা, পছন্দের উপর নজর দেয়া দরকার।
শিক্ষা-ব্যবসা যাই হোক, প্রতিষ্ঠানগুলোরও সামাজিক কিছু দায়িত্ব রয়েছে।
শুধুমাত্র ব্যয়বহুল প্যাকেজটি নিয়ে নির্দিষ্ট বিষয়টির উপর ক্লাস নিলেই যে কোন শিক্ষার্থীর বেলায় উক্ত বিষয়ে উন্নতি এবং উন্নত স্কুল কলেজে ভর্তি হবার বিষয়টি নিশ্চিত নয়, টিউটোরিয়ালে দায়িত্বরত শিক্ষকদেরকে সেই ধারণাটিও অভিবাভকদের সাথে স্পষ্ট করে আলোচনা করা দরকার।
কেননা, পড়াশুনায় সাফল্য টানতে এখানে শিক্ষার্থীর আকর্ষণ, আগ্রহ, চেষ্টা এবং মনযোগ অনেক বড় ভূমিকা পালন করে।
কারো যদি ম্যাথ, সাইন্সে আগ্রহ না থাকে, বরং আগ্রহ থাকে মিউজিক, সাইকোলোজি, বা আর্ট এর উপর, সেক্ষেত্রে টিউটোরিয়াল বা শিক্ষা একাডেমিগুলো তাকে ম্যাথ এবং সাইন্সে খুব বেশি উন্নতি ঘটাতে পারবে না। বরং তার আকর্ষণ ও আগ্রহের সাবজেক্টটির উপর আরো বেশি সাফল্য টানতে পারবে।
কাজেই সর্বপ্রথম বাবা মা হিসাবে আমাদের নিজ সন্তানকে জানতে হবে, চিনতে হবে, বুঝতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে যে, প্রতিটা শিশু ভিন্ন ভিন্ন ভাবে জন্ম গ্রহণ করে। কেউ মেধা-জ্ঞান সম্পন্ন ভাবে, কেউ শেখার অক্ষমতা নিয়ে, কেউ বা একাধিক অক্ষমতা বা সামান্য জটিলতা নিয়ে। কেউ পড়াশুনায় সেরা, কেউ খেলাধুলায় সেরা, কেউ মিউজিক বা আর্টস এ সেরা।
আমাদেরকে জানতে হবে, আমাদের সন্তানদের মেধা কোন দিকে এবং তার দুর্বলতা কোন দিকে। জানতে হবে, আমাদের সন্তানেরা ঠিক কতটা ধারণ ও গ্রহণ করার ক্ষমতা রাখে, এবং তারা কি চায়। তারপর আসবে কোন ফিল্ডে আমরা নিজের সন্তানদের পরিচালিত করবো, উৎসাহিত করবো এবং প্রয়োজনে অর্থ ব্যয়ে তাদের অগ্রগতিকে আরো উন্নত করবো।
সন্তানের অবস্থান না বুঝে যতই অর্থ্য ব্যয় করুন না কেন, কিংবা পুরস্কারপ্রাপ্ত টিওটোরিয়াল বা কুচিং সেন্টারে নেন না কেন, আপনি কোন উন্নতি আশা করতে পারবেন না। আপনার সন্তান যদি সাইন্সে দুর্বল হয়, তবে আপনি কখনোই তাকে ডাক্তার বানানোর আশা বা অর্থ ব্যয়ে নামকরা টিউটোরিয়ালে ভর্তি করেও সাফল্য আশা করতে পারেন না। বরং আপনাকে ফোকাস করতে হবে- আপনার সন্তানের আগ্রহ ও আকর্ষণ কোথায়।
তা না করে অহেতুক আশা ও চেষ্টার পর উন্নতি না হলে সেটা বাবা-মা এবং সন্তান, উভয়ের জন্য হতাশাজনক, মানসিক চাপ বৃদ্ধির কারণ।
‘আমার সন্তানকে সর্বোচ্চ ফলাফল তুলতেই হবে, কিংবা উন্নত স্কুল-কলেজে যেতেই হবে’–বাবা-মায়েদের মনে এই মনোভাব তৈরী করার পিছনে প্রতিবেশীদের ভুমিকাও অস্বীকার করা যাবে না। আমাদের একটা ‘খাচরা’ স্বভাব হল, নিজেকে বড় কিছু প্রমাণ করার চেষ্টা করা। সুযোগ পেলেই আমরা অন্যের সামনে নিজ সন্তানের সাফল্যের গান গাইতে শুরু করি। সেটাও খারাপ কিছু নয়। নিজ সন্তানের সাফল্য প্রচার করা গর্বের কথা। তবে সেটা ক্ষতিকর তখনই হয়, যখন আমরা অতিমাত্রিক গুণ-গানগুলি এমন কোন বাবা-মায়ের সামনে করি, যাদের সন্তানেরা পড়াশুনায় পিছিয়ে আছে কিংবা শেখার কোন সঙ্কটে আছে বিধায় ভাল রেজাল্ট করতে পারছে না। আমাদের এ বিষয়ে কিছুটা বিবেচক ও মানবিক হওয়া দরকার।
বাবা-মায়েদের আবারো বলবো, অর্থ ব্যয়ে সন্তানের পড়াশুনায় উন্নতি দেখার আগে, সন্তান কোন বিষয়ে স্পষ্ট মেধা রাখে এবং পড়তে আগ্রহী, তা বিবেচনায় রাখুন। কোন কিছু চাপিয়ে দিবেন না।
অন্যের সন্তান ক্লাসে হাইস্কোর পেয়েছে বলে আপনার সন্তানকেও পেতে হবে, এমন নয়। আপনার সন্তান যতটা ধারণ ও গ্রহণ করতে পারবে, ততটার উপর গুরুত্ব দিন, দেখবেন, তারা সুন্দর করে সামনে এগুলো। পড়াশুনা করে সন্তান কি হতে চায়, তা আপনার পছন্দ নয়, সন্তানের পছন্দের উপর ছেড়ে দিন, দেখবেন আপনার সন্তান ভাল কিছু উপহার দিবে আপনাকে। অন্যের সন্তানেরা কি করলো, কোথায় পড়লো, কোথায় গেল, তা নিয়ে না ভাবাই উত্তম। আপনি নিজ সন্তানকে কতটা বিশ্বাস-আস্থা, সময়, সাপোর্ট দিতে পারছেন, তা নিয়ে ভাবুন। কোনভাবেই আপনার সন্তানকে অন্যের সাফল্যের সাথে তুলনা করে কটাক্ষ করবেন না। এটা খুব মন্দ ফলাফল বহন করে। আপনার সন্তান যা বা যতটুকু করতে সক্ষম, আপনি স্বাচ্ছন্দ্য মনে ততটুকুই গ্রহণ করুণ এবং আপনার সন্তানের জন্য স্বাস্থ্যকর একটা পরিবেশ উপহার দিন। নিজে কথা কম বলুন, সন্তানকে বলতে দিন এবং তার কথা খুব মনযোগ দিয়ে শুনার চেষ্টা করুণ।
দেখবেন, বাবা-মা হিসাবে আপনি হতাশ হবেন না।