বলা হয় বয়স বাড়লে প্রতিটা মানুষই শিশুরুপে পরিণত হন। তাদের আচরণ, আবেগ, অনুভূতি, ভাবনা, গ্রহণক্ষমতা, সহনশীলতা সব কিছুতেই পরিবর্তন আসে। কারণ, প্রবীণতার একটি নতুন জীবনধারায় যুক্ত হয়ে তাঁরা বাকি দিনগুলোতে দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা নিয়ে বেঁচে থাকেন। কখনো তাদের সেই শিশুসুলভ আচরণ আমাদের বিরক্তির কারণ হতে পারে, আবার কখনো সেটা মায়া-মমতায় সম্পর্ককে আরো শক্তিশালী ও মধুর করতে পারে।
খুব কম কথা বলা, চুপচাপ স্বভাবের মানুষ আমি। কিন্তু আমার মা প্রচুর কথা বলেন এবং খুব শাসন করতে পছন্দ করেন তিনি। বলা রাখা ভাল যে, সেটা শুধু আমার সাথেই করেন। সম্ভবত ছোট মেয়ে বলে আদর, অধিকার দু’টোই বেশী তাঁর। এমনিতে, আমার মা খুবই সহজ-সাধারণ একটা মানুষ। নিজ ঘর, সংসার, সন্তান -তাঁর কাছে পুরো পৃথিবী।
বিগত ১৪ বছর যাবত তিনি নিউইয়র্কে থাকেন। একক মা হিসাবে আমাকে সহযোগীতা করতেই তিনি আমার সাথে আছেন। ছোট দুটি শিশু সন্তান মায়ের কাছে রেখেই একটা সময় দিনে চাকরী করে আবার রাতে কলেজ ক্লাস করেছি। মা না থাকলে এটা সম্ভব হতো না। কেননা, বেবি সিটারের খরচ বহন করার মত আর্থিক অবস্থায় তখন ছিলাম না। লড়াইয়ের অনেকগুলো বছর আমি পাড় করেছি মায়ের সহায়তায়। শারীরিক সমস্যাজনিত কারণে তাঁর প্রতি সঠিক সম্পূর্ণ দায়ীত্বটুকু আজ আমি ঠিক কতটা পালন করতে পারছি, জানা নেই। তবে এই বৃদ্ধ বয়সে এখনো তিনি আমাকে সহায়তা করে যাচ্ছেন।
মা বেড়াতে যেতে খুব পছন্দ করেন। নতুন যে কোন জায়গা দেখতে তিনি সেজেগুজে তৈরী হয়ে যান। মানা করলেও কাঁধের ব্যাগটিতে বাড়তি পানির বোতল, বাদাম, কিছু ফল, টিস্যুপেপার, লুকিয়ে নিয়ে নেন। সবই আমার জন্য, যদি দরকার হয়। বেড়াতে গিয়ে নামান ভঙ্গিমায় ছবি তুলাও তাঁর খুব পছন্দের একটা বিষয়। একদম ছোট বাচ্চাদের মত হাসি মুখে ছবি তুলেন। ভাল লাগে।
আমার মা বেহুদা খরচ করতে পছন্দ করেন না। জমাতে পছন্দ করেন। প্রতি মাসে মা’কে আমার বেতনের চেক থেকে দুইশত ডলার দিতে হয়। এটা বাধ্যতামূলক। সেই অর্থ তিনি জমা করেন একটি সাদা খামে। যখনই আমি আর্থিক সংঙ্কটে পড়ি, মা সাহায্য করেন। জমানো অর্থের পুরোটাই আমার হাতে তুলে দেন। বলা যায়, মা আমার হোম সেভিংস ব্যাংক।
মায়ের সাথে রোজকার গল্পগুলো হয় খুব মজার। রোজ কিছু না কিছু নিয়ে খুনসুটিতে দিন কাটে। তিনি নিজের মত করে চলতে পছন্দ করেন। দেখা যাবে, রান্না ঘরের একটা জিনিস আমি নির্দিষ্ট কোন জায়গায় রেখেছি, কিছুক্ষন পর তিনি সেটা নিজের মত করে অন্য জায়গায় গুছিয়ে রাখবেন। প্রয়োজনের সময় সেটা আমি আর খুঁজে পাব না। আমার টি-শার্ট গুছিয়ে রাখবেন বাচ্চাদের ড্রয়ারে, তাদেরটা আমার ড্রয়ারে।
ইদানিং কোভিড-১৯ জনিত কারণে মা’কে বেশ সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। বন্ধু পরায়ন আমার মা তাঁর বান্ধবীদের বাড়ি যেতে পারছেন না, আড্ডা দিতে পারছেন না। এটা তাকে খুব হতাশ করছে। তাই তাঁর শখের সবজী বাগানটা ঠিকঠাক মত করে দেবার চেষ্টা করছি। বাগান তাঁর খুব পছন্দ। বাগানে সবজী ফলতে দেখলেই তাঁর মুখে হাসি ফুঁটে যায়। করলা, লাউ, কুমড়া, মরিচ, টমেটো, ধনেপাতা, ঢেরস, আলু… কি নেই মায়ের বাগানে!
করোনাকালীন রিমোট লার্নিং এবং শিক্ষা পদ্ধতিতে থাকার কারণে দিনের অনেকটা সময় মা’কে একা থাকতে হয়। এটা আমাকে খুব হতাশ করে। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বাচ্চারা লেপটবপে ক্লাস করে। আমাকেও ক্লাস নিতে হয়। ক্লাস চলাকালীন পুরো সময়টা আমার কক্ষে মা এবং বাচ্চাদের যাতায়াত নিষিদ্ধ। কারণ, অনেক শিক্ষকরা স্ক্রিনে শিক্ষা প্রদানের সময় ব্যাকগ্রান্ড ব্যবহার নিয়ে সমস্যায় পড়েন। বিশেষ করে যাদের ঘরে শিশু সন্তান, বৃদ্ধ মানুষ রয়েছেন। স্কুল শিক্ষা সময়ে হুট করে স্ক্রিনের সামনে পরিবারের অনন্যদের উপস্থিতি বিরাট এক সমস্যায় ফেলে দেয় আমাদের। স্কুল প্রশাসন এবং পেরেন্টসদের অভিযোগ থেকে রক্ষা পেতে এবং নিজ চাকরীর স্থায়ীত্ব বজায় রাখতে এই ‘স্ক্রিন ব্যাকগ্রাউন্ড’ ব্যবহারের বিষয়টাও আমাদের জন্য মানসিক চাপ তৈরী করছে। এ নিয়ে অনেক সময় পেরেন্টেসদের অভিযোগের মুখে পড়তে হয় আমাদের। অন্যদিকে বাচ্চাদের বেলায় একই অবস্থা।
মা সে সময়টুকু নিজ কক্ষে, লিভিং রুম এবং রান্না ঘরেই থাকেন। সুযোগ বুঝে আমি আসি খোঁজ নিতে। সে সময়টুকুতে মা খুব কথা বলেন দেশে পরিবার-আত্বীয়দের সাথে। মন্দ কাটেনা সময়। তবে আমার খারাপ লাগে এতটা সময় মা’কে বিচ্ছিন্ন করে রাখতে।
আমার মা খুব একরোখা। শাসন করতে পছন্দ করেন তিনি। এখনো আমাকে ছোট শিশুটির মতন শাসন করেন। রাত ১০টার পর কোথাও থাকা যাবেনা, অহেতুক টাকা খরচ করে শপিং করা যাবে না, খাবার নষ্ট করা যাবে না… ইত্যাদি বিষয়গুলোতে তিনি খুব কঠোর। কারো সাথে দীর্ঘক্ষন ফোনালাপ হলে বার বার ঘরে এসে উকি দিয়ে যাবেন। দরজার সামনে দিয়ে হাঁটবেন। মেয়ে কার সাথে কথা বলছে, কেন বলছে, কত কি ভাবনা তাঁর। প্রাপ্ত বয়সে উপনিত হয়ে আজও আমি তাঁর শাসনে থাকি। মাঝে মাঝে যে বিরক্ত হইনা, তা নয়। তবে বিরক্তিটা প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকি। করুক না শাসন! বয়স হচ্ছে। একদিন বিদায় নিবেন। তখন এই শাসনগুলোই খুঁজে খুঁজে হয়রান হবো।
প্রতিটি প্রক্রিয়ারই শুরু এবং শেষ আছে। জীবন শুরু হয়, তারপরে শেষ হয়। আবারও জীবন শুরু হয়। এভাবেই চলছে মহাবিশ্ব।এই মহাবিশ্বে কোন কিছুরই স্থিরতা নেই।এটাই প্রকৃতির নিয়ম। প্রকৃতির নিয়মে আমাদের মায়েরাও বৃদ্ধ হন।
বন্ধু হারাতে থাকেন, স্মৃতি হারানোর সমস্যার মুখোমুখি হন। এ্যালজাইমার এবং অন্যান্য ধরণের ডিমেনশিয়াজনিত সমস্যাগুলোর সন্মুক্ষিন হন। এ সময়টাতে তারা নিজেদের অবহেলিতবোধ ভাবতে শুরু করেন। তাঁরা মনে করেন যে পরিবার এবং আশেপাশের লোকদের কাছে তাঁরা মনযোগ পাচ্ছেন না। আর সে কারণেই পরিবাদের সদস্যদের প্রতি তাদের আচরণ, ধরণ, মেজাজ অনেকটা খিটখিটে হয়ে যায়।
এটাই স্বাভাবিক।
তারপরও মায়েদের ভালবাসতে হবে। যত্নের সাথে তাদের আবেগ, অনুভূতি, ছোট-খাটো সমস্যাগুলো মোকাবেলা করতে হবে। তাদের শিশুসুলভ মনটাকে বুঝতে হবে।
আমি সেটা করার চেষ্টা করি। মায়ের আদরের পাশাপাশি তাঁর শাসন, পছন্দ, অপছন্দ, হতাশা বুঝার চেষ্টা করি। কতটা পারি জানা নেই, চেষ্টা অব্যাহত রাখি।
বয়স বাড়ছে। একদিন বিদায় দিতে হবে। ভাবতেই মনে অস্থিরতা ছেয়ে যায়। ভাবি, মা’কে ছাড়া আমার কি হবে?
Post Views:
167
মা আমায় এখনো শিশু ভাবেন
Published by HB Rita on Monday, May 10th, 2021