প্রতিটি প্রক্রিয়ারই শুরু এবং শেষ আছে। জীবন শুরু হয়, তারপরে শেষ হয়। আবারও জীবন শুরু হয়। এভাবেই চলছে মহাবিশ্ব। এই মহাবিশ্বে কোন কিছুরই স্থিরতা নেই। এটাই প্রকৃতির নিয়ম।
প্রকৃতির নিয়মে একজন ব্যক্তি বৃদ্ধ হন। তিনি প্রবীণতার একটি জীবনধারায় যুক্ত হন। এই জীবনে দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা নিয়ে তাঁরা বেঁচে থাকেন। বন্ধু হারাতে থাকেন, স্মৃতি হারানোর সমস্যার মুখোমুখি হন। এ্যালজাইমার এবং অন্যান্য ধরণের ডিমেনশিয়া জনিত সমস্যাগুলো শুরু হয়, যা মোকাবেলা করা খুব বেশী কঠিন হয়ে পরে তাদের জন্য। এ সময়টাতে বৃদ্ধরা খুব অবহেলিত বোধ করতে শুরু করেন। তাঁরা মনে করেন যে পরিবার এবং আশেপাশের লোকদের কাছে তাঁরা মনযোগ পাচ্ছেন না। আর সে কারনেই পরিবাদের সদস্যদের প্রতি তাদের আচরণ, ধরণ, মেজাজ অনেকটা খিটখিটে হয়ে যায়। এখানে একটা বিষয় আমাদের মনে রাখা জরুরী যে, স্মৃতিভ্রংশের কারণে তাদের কথা বা কাজগুলিতে তাদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকে না। তবু, আমরা বিচলিত হই, বিরক্ত হই বৃদ্ধ পিতা-মাতা এবং পরিবারের অনন্যদের উপর।
প্রতিদিন কাজে যাবার সময় আমার ৭৩ বছর বয়সী বৃদ্ধা মা জেগে উঠেন। প্রয়োজন নেই তবু এসে লাঞ্চ ব্যাগ গুছাবেন। ব্রেকফাষ্ট, লাঞ্চ গুছাতে গিয়ে প্রায়ই সব উলটপালট করে দেন। আমার কাজে যেতে কখনো কখনো দৌড়াতে হয়। একদিন এমন হল যে আমার ব্যাগ গুছাতে গিয়ে আম্মু কফির ফ্লক্সের ঢাকনাটা ঠিকমত লাগাতে পারেননি। আমি তখন ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ছুটছি গাড়ীর দিকে। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম গরম কিছু আমার শরীরে লাগছে। সেটা ছিল কফি। ঢাকনা ভালমত না লাগানোতে ফ্লাক্স কাত হয়ে সব কফি পড়েছে আমার গায়ে। কাপর নষ্ট, সে সাথে ব্রেকফাষ্ট ও লাঞ্চ নষ্ট। এদিকে অফিস টাইম হয়ে এসেছে, নাস্তা কেনার সময় নেই।
বিষয়টা তেমন কিছুই না। আবার অফিস যাওয়ার আগ মুহূর্তে কাপর ও খাবার নিয়ে অহেতুক ঝামেলাটা চরম বিরক্তিকর। আমি বিরক্ত হলাম। তবে আম্মুর উপর নয়, পরিস্থিতিটার উপর। আমার মনে হল, তিনি নিশ্চয়ই ইচ্ছে করে ফ্লাক্সের ঢাকনা খুলে রাখেননি। বয়স হয়েছে। এখন কোনকিছুই সম্পূর্ণ হবেনা। হয়তো ঢাকনাটা শক্ত করে লাগাতে পারেননি কিংবা বুঝতে পারেননি। তিনি যে ভোর বেলা ঘুম ভাঙিয়ে আমাকে সাহায্য করতে প্যাকআপ করে দিলেন, সকালে আমার সময় বাঁচানোর জন্যই দিয়েছেন। এবং তার এই বাড়তি যত্ন ও মমতাই মিলিয়ন ডলার্সের অধিক।
ব্যক্তিগত এই বিষয়টি তুলে ধরার উদ্দেশ্য হল, বৃদ্ধ পিতা মাতার প্রতি আমাদের নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা। বয়সজনিক কারণে আমাদের মা-বাবারা নানান অসতর্কতামূলক কাজ করে থাকেন। কানে কম শোনেন, চোখে কম দেখেন, একই কথা বার বার বলেন, ইস্ত্রী করতে গিয়ে সন্তানের দামী কাপরটি জ্বালিয়ে দেন, রান্না করতে গিয়ে খাবার পুড়িয়ে দেন, অহেতুক রাগ করেন, মেজাজ তুঙ্গে রাখেন। বয়সের সাথে সাথে তারা শিশু হতে থাকেন। হয়তো একদিন আমরাও এমন শিশুসুলভ আচরণ করবো। মা-বাবার সেই অসচেতনতা ও শিশুসূলভ আচরণগুলোকে বিরক্তির সাথে না নিয়ে, তাদের মনে আঘাত না করে সহনশীলতা ও সহমর্মীতার সাথে মানিয়ে নেয়া প্রতিটা সন্তানের দায়ীত্ব ও কর্তব্য।
আমরা প্রায়ই বৃদ্ধ পিতা-মাতার প্রতি ধৈর্যহীন হয়ে পড়ি। কঠোর আচরণ তাঁদের অক্ষমতাকে প্রকাশ করি। আমরা ভুলে যাই, একদিন আমরাও রাতভর তাদের ঘুমাতে দেইনি। একদিন আমরাও সারাক্ষণ তাদের কোলে থেকে পিঠের ব্যথা বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। একদিন আমাদের মলমূত্র কোলে রেখেও তাঁরা খেতে বসেছেন, অহেতুক বাহানায় নিজের ভাগেরটা আমাদের খেতে দিয়েছিলেন। একদিন তাঁরাই মুরগীর ঝোলে গলা-পা চেটে খেয়ে বুকের মাংসটা আমাদের খাইয়েছেন। আহা! কত কি আমরা ভুলে যাই! বয়স জনিত কারণে স্মৃতি শক্তি হারানোর দ্বায়ে আমরা তাদের এ্যালজাইমার রোগী বলি। আসলে আমরাই আসল এ্যালজাইমারে আক্রান্ত। কেননা আমরা তাঁদের এক জীবনের পুরো কৃতিত্ব ভুলে যাই।
মা-বাবাকে যত্ন করতে খুব বেশী কিছুর প্রয়োজন হয়না। সামান্য যত্ন সহকারে কথা বলা, খেয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করা, ডাক্তারের কাছে নেয়া, অবসর সময়ে কিছু সময় তাদের পাশে বসে পুরোনো স্মৃতিগুলো নিয়ে আলাপ করা, বাহিরে বেড়াতে নিয়ে যাওয়া..এই তো! তাদের বুঝানো যে আমরা সন্তান হিসাবে তাদের প্রতি সম্পুর্ণ সন্মান ও ভালবাসা বিতরণ করছি।
একজন মা দশ মাস দশ দিন পাঁচ-ছয় কেজি বাড়তি ওজন পেটে ধারণ করে শরীরের হাড় ফাটিয়ে আমাদের জন্ম দেন। একজন পিতা নিজে ছিঁড়া জুতো পড়ে আমাদের দামী জুতো কিনে দেন। অসুস্থ্যতা নিয়েও মাসিক উপার্জন ঠিক রাখেন যেন আমরা খেতে পারি, পড়াশুনা করতে পারি, ভাল কাপড় পরিধান করতে পারি। তাঁদের প্রতি যত্নশীল হতে আর কোন কারণ প্রয়োজন আছে বলে মনে হয়না।
বৃদ্ধ বয়সে পিতা-মাতারা যত্ন, ভালবাসা এবং স্নেহের জন্য কাঙ্গাল হন। সে সময়টাতে তাঁদের চাহিদা এবং উদ্বেগগুলি বুঝতে পারা, তাদের সুস্বাস্থ্যের বিষয়টিকে নিশ্চিত করে। প্রবীণদের প্রতি একটি মানসিক সমর্থন তাদের আনন্দময় রাখে যা অবশ্যই একটি স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের আদর্শ ও উপায়।
তাই, বাবা-মাকে সম্মান করুন। তাঁদের সাথে থাকতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করুন। তাঁদের সাথে মুহুর্তগুলি উপভোগ করুন। তাঁদেরখুশি রাখুন। তাঁদের সাথে যতটা সম্ভব সময় ব্যয় করতে পারেন, করুণ। করুণ কখনও ধমক দেবেন না, অনুভূতিতে আঘাত করবেন না। তাঁদের প্রতি নির্দয় হবেন না। বৃদ্ধকালে তাঁরাই আপনার, আমার, আমাদের সন্তান। একবার তাঁরা বিদায় নিলে, আমরা তাঁদের আর ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হবোনা। স্মৃতি খুঁজে খুঁজে আমরা হয়রান হবো, বাবা-মাকে কোথাও পাবোনা।
বৃদ্ধ পিতা-মাতা আমাদের শিশু
Published by HB Rita on Thursday, June 18th, 2020