সবুজ পতাকায় রক্ত লাল বৃত্তে বিউটিফুল

5FFC4340-3FB2-4A80-AE3E-D241D2915BBAতারুন্যের উদ্দীপনা ও বিস্তৃত গ্রাম বাংলার প্রতিক উজ্জল ঘন সবুজের উপর, লাল রঙ্গের ভরাট বৃত্তে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে ছিনিয়ে আনা স্বাধীনতার নতুন সূর্য্যকে প্রতিকিরুপে সাজানো চিত্রশিল্পী কামরুল হাসান কি জানতেন যে, তার এই সাক্ষর একদিন হুবহু নকল হবে?

সবুজের উপর লাল বৃত্তটি ভরাট করতে তিনি বিশেষ রঙ ও চিত্তশৈলীকে ব্যবহার করেছিলেন। তিনি জানতেন না, আজকের বাংলাদেশের পতাকায় বৃত্ত ভরাট হয় রক্তমাখা নারীর শরীরে।

হবিগঞ্জের ব্রাহ্মণডোরা গ্রামের দিনমজুর সায়েদ আলীর ক্ষমা অযোগ্য অপরাধ ছিল- একটি মেয়ে সন্তান জন্ম দেয়া। বাংলাদেশ সংবিধানে এই অপরাধের কোন ক্ষমা নেই। তাই তো দিন মজুরের কিশোরী মেয়েকে এক মাস আটকে রেখে ধর্ষণ এবং ধর্ষণের মামলা করায় ফের ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়েছে।
মেয়েটির নাম বিউটি আক্তার।

গত ২১ জানুয়ারি ব্রাহ্মণডোরা গ্রামের দিনমজুর সায়েদ আলীর মেয়ে বিউটি আক্তারকে বাড়ি থেকে অপহরণ করে নিয়ে যায় বাবুল মিয়া ও তার সহযোগীরা। এক মাস তাকে আটকে রেখে ধর্ষণ করে। এক মাস নির্যাতনের পর বিউটিকে কৌশলে তার বাড়িতে রেখে পালিয়ে যায় বাবুল। এ ঘটনায় গত ১ মার্চ বিউটির বাবা সায়েদ আলী বাদী হয়ে বাবুল ও তার মা কলমচানের বিরুদ্ধে হবিগঞ্জ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে অপহরণ ও ধর্ষণ মামলা দায়ের করেন। পরে মেয়েকে সায়েদ আলী তার নানার বাড়িতে লুকিয়ে রাখেন। এরপর বাবুল ক্ষিপ্ত হয়ে ১৬ মার্চ বিউটি আক্তারকে উপজেলার গুনিপুর গ্রামের তার নানার বাড়ি থেকে রাতের আঁধারে জোর করে তুলে নিয়ে যায়। ফের ধর্ষণের পর তাকে খুন করে লাশ হাওরে ফেলে দেয়।

কে এই কুখ্যাত বাবুল মিয়া?
শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলার ব্রাহ্মণডোরা গ্রামে মৃত মলাই মিয়ার ছেলে বাবুল মিয়া (৩০) বিবাহিত এবং দুই সন্তানের জনক। ২০১০ সালে সে সিলেটের এক প্রবাসীর স্ত্রী তাসলিমা আক্তারকে নিয়ে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে। বিয়ের পরও থেমে থাকেনি তার ব্যাভিচার। একাধিক নারীর সঙ্গে গোপন সম্পর্ক স্থাপন করে তাদের ব্ল্যাকমেইল করা, রাস্তাঘাটে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের উত্ত্যক্ত ও হয়রানি করা ছিল তার নিত্য ঘটনা। এলাকায় প্রভাবশালী ক্ষমতার বলে সে যা খুশী তাই করে বেড়াত এবং নিরীহ লোকজন কেউ তার ভয়ে প্রতিবাদ করার সাহস পেতনা। ছেলের এসব অনৈতিক কার্যকলাপ সম্পর্কে তার মা ইউপি সদস্য কলমচান বিবি অবগত থাকলেও ছেলের কর্মকাণ্ডের বিষয়ে কলমচানের কাছে বিচার দিয়ে এলাকাবাসী বরাবরই বিফল হয়েছেন।

দ্বিতীয় ধর্ষণ ও হত্যার পর ১৭ মার্চ বিউটির বাবা সায়েদ আলী যখন বাদী হয়ে বাবুল মিয়াসহ দুজনের নাম উল্লেখ করে শায়েস্তাগঞ্জ থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন, তখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টনক নড়ে। পরে ২১ মার্চ পুলিশ বাবুলের মা কলমচান ও সন্দেহভাজন হিসেবে একই গ্রামের ঈসমাইলকে আটক করে। কিন্তু যখন ১ মাস আটকে রেখে বিউটিকে প্রথম ধর্ষণের পর গত ১ মার্চ বিউটির বাবা সায়েদ আলী বাদী হয়ে বাবুল ও তার মা কলমচানের বিরুদ্ধে হবিগঞ্জ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে অপহরণ ও ধর্ষণ মামলা দায়ের করেন, তখন আইন শৃঙ্খলা বাহিনী কোন ব্যবস্থা নেননি কেন? শুরুতেই যদি এই অপরাধীর বিরুদ্ধে প্রসাশন কঠোর হতো, তাহলে আজ বিউটি আক্তার বেঁচে থাকতো। তবে কি ধরে নিব যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উদ্দ্যগ ও কর্ম তৎপরতায় “একটি লাশ” একান্ত জরুরী? তবে কি সাংবিধানিক আইন রাতের আঁধারে বদলে দেয়া হয়েছে? তবে কি ধরে নিব শুধু ধর্ষণ নয়, এখন ধর্ষণের পর “লাশ” হতে হবে পুলিশী সাহায্য পেতে? রিডিকিউলাস!!!

একটা প্রশ্ন করতে চাই সামাজিক ব্যাধীতে আক্রান্ত ও ব্যাধী সৃষ্টিকারী পুরুষদের- কোন মেয়ে আপনাদের ডাকে সাড়া না দিলেই তাকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে মেরে ফেলতে হবে, কোন মেয়ে বেপর্দা রাস্তায় বের হলেই তাকে ধর্ষণ করতে হবে, এমনটা কোরআন বা সংবিধানের কোন অনুচ্ছেদে উল্লেখ্য আছে? আপনি বরং নিজের জীবন রিস্কে না নিয়ে বিকৃত যৌন বাসনা চারিতার্থ করতে নিজের মা-বোনকে আকুতি জানান। দেখুন তারা আপনাকে কিভাবে সাহায্য করে! সেখানেও গতি না হলে নিজ পরিবারকে বলুন টাকার যোগান দিতে। বলুন, আপনি বেশ্যাপাড়ায় যেতে চান। সরকার বৈধ বেশ্যাপাড়া উন্মুক্ত রেখেছে আপনাদেরই জন্য।

ধর্ষণ এখন কেবল সামাজিক ব্যাধী নয়। এটি একটি মানসিক ব্যাধীও। নারীর প্রতি এই সহিংসতা কেবল যৌন ক্ষুধা মেটানোর জন্য নয়, এই সহিংসতার পিছনে রয়েছে খন্ড খন্ড বহু কারণ। কিছু কারণ সাম আপ করার চেষ্টা করছি-
১। পারিবারিক অবহেলায় পিতা মাতা কতৃক নৈতিকতাবোধ শিক্ষার অভাব
২। ধর্মীয় শিক্ষার অভাব
৩। নারীর উপর অধীকার দখলের প্রবনতা
৪। পিতা-মাতার অসহিন্জুমূলক সম্পর্কে নারীর প্রতি লিঙ্গ বৈষম্য
৫। পর্নোগ্রাফি
৬। সেক্স এডুকেশনের অভাব
৭। সঠিক মানসিক বিকাশে পিতা-মাতার দায়হীনতা
৮। পিতা-মাতার চারিত্রিক অধপতন
৯। মাদকদ্রব্য
১০। শিশু বয়সে নারী-পুরুষ কর্তৃক শারীরিক বা যৌন নির্যাতন
১১। আইনের ভুল প্রয়োগ
১২। রাষ্ট্রীয় উদাসীনতা।

উপরোক্ত কারনসমূহের মধ্যে একটি কারণ গ্রহনযোগ্যতা নাও পেতে পারে, সেটি হল- সেক্স এডুকেশন। আমি মানছি যে আমরা মুসলমান হিসাবে কিছু সীমারেখার মাঝে বাস করি। কিন্তু তার সাথে সন্তানের চারিত্রিক গঠনে সেক্স নিয়ে আলোচনা করার কোন সম্পর্ক নেই। একজন পিতা পারেন তার সন্তানকে এ বিষয়ে জ্ঞান দিতে। সন্তানকে বোঝান যৌন তাড়না প্রতিটি শরীরের একটি স্বাভাবিক প্রতিক্রীয়া। তাকে বোঝান কি করে এই অনুভূতি মোকাবেলা করতে হয়। যৌনতার সঠিক বয়স মাথায় রেখে সন্তানকে বোঝান এটির ভুল ব্যবহার অন্যায় ও পাপ। সন্তানের কম্পিউটার-মোবাইল ব্যবহারে নজর রাখুন। সন্তানকে সময় দিন, তার শারীরিক মানসিক বিকাশে রোল মডেল হয়ে নিজেদের দাড় করান। স্বামী মদ্যপ হয়ে বউ পিটালে, ব্যাভীচার করলে, স্ত্রী দিনরাত পার্টি-সোস্যাল মিডিয়া নিয়ে পড়ে থাকলে, স্বামী রেখে অনৈতিক সম্পর্কে ফোনালাপে ব্যস্ত হলে, সে পরিবারের সন্তান বিপদগামী হবেই। মানছি, ইমামের সন্তানও ধর্ষণ করে! তবে তা সীমিত। যারা করেন, তারাও পিতা-মাতার অবহেলার শিকার। হোক ইমাম কি সন্ত্রাসীর সন্তান।

ফিরে আসি বাবুল মিয়ার কথায়। অবশেষে গতরাতে বিয়ানীবাজার ফুফুর বাড়িতে লুকিয়ে থাকা বিউটি ধর্ষণ ও হত্যার মূল আসামী বাবুল মিয়াকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছে র‍্যাব-৯। ধর্ষণ ও হত্যার মত অপরাধ করেও বাবুল মিয়া ঠিকি তার ফুপুর কাছে আশ্রয় খুঁজে পেয়েছে। এই স্বজনপ্রীতি অনৈতিক, অমানবিক। এমন স্বজনপ্রীতির জন্য তার ফুপুকেও গ্রেপ্তার করা যুক্তিসঙ্গত বলে মনে করছি।
বাবুল মিয়ার মত একাধীক ধর্ষক প্রতিদিন গ্রেপ্তার হয়। তারপর ফেসবুকসহ বিভিন্ন সোস্যাল মিডিয়া, পত্রীকা ও টিভি চ্যানেলগুলো ভাবেন, আসামী গ্রেপ্তার হয়েছে এবার থেমে যাই। পরবর্তী ঘটনা আর আমরা কেউ জানিনা। জানার চেষ্টাও করিনা। উত্তেজনা কমে গেলেই ধর্ষকরা টাকা ও ক্ষমতার জোরে কলুষিত আইন রক্ষাকারীদের বদৌলতে কোন না কোনভাবে আইনের চোখ এড়িয়ে বেড়িয়ে যান।
তাই অপরাধীকে উপযুক্ত শাস্তি দিতে সর্বস্তরের মানুষের দরকার একতা এবং যতক্ষন পর্যন্ত অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত না হচ্ছে, দরকার ততক্ষন পর্যন্ত নিজ নিজ অবস্থানে থেকে আন্দোলন করা।

আমরা কখনোই জানবনা ১ মাস আটকা পড়ে রোজ ধর্ষণের শিকার হওয়া ১৬ বছরের কিশোরী বিউটির দুঃসহ যাতনা। আমরা কখনোই জানবনা কি পাশবিক নির্যাতনে সে রাতে বিউটিকে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়েছিল!
বিউটি ফিরে আসবেনা। তার অসহায় পিতা-মাতা কোনদিনও ভুলতে পারবেনা এই শোক। আমরা বলি, তারা অন্তরে ধারণ করেন। তবু সৃষ্টিকর্তার কাছে আকুতি, বিউটির পিতা মাতাকে সহনশীল করুন। আর কোন বিউটিকে যেন এবাবে যেতে না হয়, রহম করুন।