প্রশ্ন আমাদের জ্ঞান প্রসারিত করে

একটা সময় আমাদের চারপাশে বেয়াদবের সংখ্যা নেহায়েত কম ছিল। যা ছিল, তা সবই আদবে ভরা। কেননা ছোট থেকেই আমাদের শিখানো হত বড়দের মুখে মুখে কথা বলতে নেই। প্রশ্ন করতে নেই-তর্ক করতে নেই। তাদের চোখের দিকে তাকিয়ে কথাবলতে নেই। বললে, সেগুলি বেয়াদবি। এবং আমরা সেগুলিই মেনে চলতে গিয়েই আদবে থেকেছি।

বেয়াদবির ভয়ে আমরা কখনো ‘আই কন্টাক্ট’ করিনি। কখনো প্রশ্ন করিনি, বড়দের সাথে কথার পিঠে কথা তুলে বিশ্বকে জানার চেষ্টা করিনি।

আমাদের বলা হত ‘মিথ্যা বলা মহাপাপ।’ তাই আমরা সব সময় সত্য বলার চেষ্টা করতাম। আবার বড়দের প্রয়োজনে কোন গোপনীয়তা রক্ষা করতে গিয়ে বলা হত, ‘এই শোন! এটা যে তুই শুনেছিস বা দেখেছিস, তা কিন্তু কাউকে বলবিনা।’
শিশু বয়সে তখন আবার আমরা বিভ্রান্ত হয়ে যেতাম। বুঝতে পারতাম না ঠিক কোন সময়টাতে মিথ্যা বলা মহাপাপ এবং কোনসময়টাতে সত্য বলা বিপদ হতে পারে।

পরিবর্তে, আমাদের কখনোই শিখানো হতো না সত্য-মিথ্যার পার্থক্য, প্রয়োগ বা ব্যবহার। কিংবা কখন সত্য বলা দরকার, কেনবলা দরকার, কখন সত্য এড়িয়ে মিথ্যাকে প্রশ্রয় দেয়া জরুরী, এসব বিষয়ে প্রশ্ন করার দুঃসাহস আমাদের ছিল না। কারণ আমরা শিশুকালে বেয়াদব ছিলাম না, আদবে বেড়ে উঠেছি।

ছোটকালে আমরা জেনেছি চাঁদের কাল দাগের মধ্যে চাঁদের বুড়ি বাস করে। বলা হত, চাঁদের কালো দাগগুলো হল চাঁদের কলঙ্ক। আসল ঘটনা আড়ালে রেখে সেই কাল্পনিক বিশ্বাস নিয়েই আমরা বেড়ে উঠেছি। অথচ চাঁদের পাশটির ৩১ ভাগ কালো দাগে ভরারহস্যটির নাম যে বিজ্ঞানীদের কাছে ‘লুনার মারিয়া’, তা আজও আমরা অনেকেই জানিনা।

কিন্তু আজকের বেশীর ভাগ শিশু বা অন্যরা চাঁদের সেই কালো দাগের রহস্য এবং এর উৎপত্তি সম্পর্কে আমাদের থেকে কিছুটা বেশীই জানে। কেন? কারণ তারা ছোট থেকেই প্রশ্ন করতে জানে এবং এখন অনেক পিতা-মাতারাই তাদেরকে প্রশ্ন করে জানার সুযোগ দেন।
প্রতিটা মানুষ জন্মের পর তাদের প্রথম পাঁচ বছরে উন্নয়নের চারটি প্রধান ক্ষেত্র জুড়ে দ্রুত বিকাশ লাভ করে। যেমন-মোটর-শারীরিক (motor-physical), ভাষা এবং যোগাযোগ (language and communication),জ্ঞানীয় (cognitive) এবং সামাজিক ওসংবেদনশীল (social/emotional)|

জ্ঞানীয় বিকাশের অর্থ শিশুরা কীভাবে চিন্তাভাবনা করে, প্রচার-প্রসার করে এবং অনুসন্ধান বা খোঁজে বের করে। এটি জ্ঞান, দক্ষতা, সমস্যা সমাধান এবং স্বভাবের বিকাশ, যা বাচ্চাদের আশেপাশের বিশ্ব সম্পর্কে চিন্তাভাবনা এবং বুঝতে সহায়তা করে। মস্তিষ্কের বিকাশ জ্ঞানীয় বিকাশের একটি অংশ।

আমাদের আজকের প্রজন্মকে হিসাবে নিলে মুরুব্বিরা ধরে নিতে পারেন যে, বর্তমানে ঘরে ঘরে বেয়াদবে ভরা। কারণ আজকের শিশুরা আই কন্টাক্ট করে কথা বলে, বরং চোখ নামিয়ে বড়দের সাথে কথা বলাকে এখন অভদ্রতা-বেয়াবদি ধরা হয়।

আই কনটাক্ট বা চোখের যোগাযোগ এক ধরনের দেহভাষা যা যোগাযোগ এবং কথোপকথনের সময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমরা কারো সাথে কথা বলার সময় চোখে চোখে যোগাযোগ রাখা মানে হল, আমরা সক্রিয়ভাবে অপর পক্ষেও কথা শুনছি এবং মনোযোগ দিচ্ছি। আমরা তা উপলব্ধি করি বা না করি, আমরা সর্বদাই কিন্তু যোগাযোগের ফর্ম হিসাবে আমাদের চোখ ব্যবহার করে থাকি। অথচ আমরা অনেকেই এই বিষয়টা থেকে বিতারিত ছিলাম ছোটকালে।

শিশুকাল বাদ দিলেও আমরা আজ দেখতে পাই যে, প্রাপ্ত বয়সে উপনীত হয়েও আমরা অনেক সময় জ্ঞানী, গুনি, বিজ্ঞজনদের প্রশ্নের সম্মুখীন করতে পারি না। আমাদের ভিতর একটা ধারণা লেপ্টে আছে যে, অতীতের কবি-সাহিত্যিক, দার্শনিক, বুদ্ধিজীবীরা যা ভেবে গেছেন বা লিখে গেছেন, সেটাই চিরসত্য, এর কোন সংস্কার বা পরিবর্তন নেই এবং সেটা মেনে নিয়েই আমাদেরকে নতুন কিছু আবিষ্কার করতে হবে। তাঁরা কি বলে গেছেন, কেন বলে গেছেন, এর যুক্তি-অযুক্তি কোন কিছু নিয়েই এখানে কোন প্রশ্ন করা চলবে না। প্রশ্ন করতে গেলেই আমারা কটাক্ষের পাত্রে পরিনত হবো।

২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১১ মে শুক্রবার যুগান্তর পত্রিকায় ‘আমি রাজাকার : একটি আলোকচিত্র’ নামে একটি আর্টিক্যাল প্রকাশ করেছিলেন। কোটা আন্দোলনের সময় অনেক ছাত্রবুকের মধ্যে ‘আমি রাজাকার’ শব্দটি লিখে পথে নামায় তিনি দারুনভাবে হতাশ ও রাগান্বিত হয়েছিলেন। ‘আমি রাজাকার : একটি আলোকচিত্র’ আর্টিক্যালটিতে তিনি লিখেছিলেন,

“যখন দেখি একজন ছাত্র নিজের বুকে ‘আমি রাজাকার’ কথাটি লিখে গর্বভরে দাঁড়িয়ে আছে, আমি সেটি বিশ্বাস করতে পারিনি। মাথায় আগুন ধরে যাওয়া বলে একটা কথা আছে, এই কথাটির প্রকৃত অর্থ কী আমি ওই ছবিটি দেখে প্রথমবার সেটি অনুভব করেছি।”
তিনি বলেছিলেন, ‘কোটাবিরোধী আন্দোলন করে যে বাংলাদেশের মাটিতে নতুন রাজাকারের পুনর্জন্ম হয়েছে, এ দেশের তরুণরা নিজেদেও রাজাকার হিসেবে পরিচয় দিয়ে গর্ব করতে শিখেছে, আমাদের সংবাদমাধ্যম সেই খবরটি আমাদের কেন জানাল না?’
শ্রদ্ধেয় স্যারের এই ভাবনাগুলো নিয়ে তাঁকে প্রশ্নবিদ্ধ করে আমি যখন নিউইয়র্কের সাপ্তাহিক ঠিকানা পত্রিকায় একটি কলাম লিখি, তখন সেটা নিয়ে অনেকেই পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘এই! তুমি কি জানো তুমি কাকে প্রশ্ন করছো?’

মূল কথা হল, বিখ্যাত গুনীজনদের মতামত, বিশ্বাস, ধারণাকে আমাদের বিশ্বাস করতেই হবে। আমরা তাদের প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারবো না। করলে সেটা হয় বেয়াদবি কিংবা পন্ডিতি।

খ্রিস্টের জন্মেরও চারশ বছর আগে উপলব্ধি করা হয়েছিল মানুষের সৃজনশীলতা। উপলব্ধি করেছিলেন গ্রিসের বিখ্যাত দার্শনিক প্লেটোও। সাহিত্য সমালোচনায় প্লেটোর যুক্তি ছিল যে, সাহিত্য ব্যক্তি এবং সমাজের জন্য নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। প্লেটো বিশ্বাস করেছিলেন যে, কবিতা সমাজকে কলুষিত করে এবং লুণ্ঠন করে। কারণ কবিতা আমাদেরকে অনৈতিকতা, মন্দ, খারাপ আচরণ এবং বর্বরতা শেখায়। কবিতার চরিত্রগুলি মিথ্যা কথা বলে, প্রতারণা করে এবং মানুষকে নির্যাতনের মাধ্যমে উপভোগ করে। তাই তিনি মনে করতেন, কবিতা বিপজ্জনক এবং বাস্তব থেকে আমাদেরকে আরও দূরে নিয়ে যায়।

এখন, প্লেটো নেই। তবে লিখনীর মাধ্যমে ইতিহাসের পাতা ও মানুষের মনে আছে তার অস্তিত্ব। কেউ যদি এখন প্লেটোর সাহিত্য সমালোচনা নিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়েন, তবে কি সেটা অপরাধ হবে? দার্শনিক প্লেটোর প্রতি অসন্মান হবে? প্রশ্নের উপর প্রশ্ন কি আমাদেরজ্ঞানকে উন্মুক্ত করে নতুন কিছু শিখাতে বা আবিষ্কার করতে সাহায্য করে না?

বাস্তব বুদ্ধিসম্পন্ন দার্শনিক প্লেটো আবেগ নয়, ‘সদগুণই জ্ঞান’ বলে বিশ্বাস করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, প্রকৃত জগতটি সত্যই ‘আসল’ জগত নয়; পরিবর্তে, আসল বাস্তবতা আমাদের শারীরিক জগতের বাইরে রয়েছে। অর্থাৎ তিনি শুধুমাত্র ইন্দ্রিয় দ্বারাপৃথিবী দেখাকে সত্যি মনে করতেন না। তিনি বিশ্বাস করতেন, ইন্দ্রিয়ের ঊর্ধ্বেও চিরস্থায়ী একটি জগত আছে, যা কেবল আমরাসীমানা থেকে মুক্ত হতে পারলেই দেখতে পারবো।

প্লেটো তাঁর এই ধারণায় সর্বাধিক বিখ্যাত রচনা করেছেন- The allegory of the Cave বা ‘গুহার রূপক’, যা তাঁর রিপাবলিকবইয়ের সপ্তম-এ পাওয়া। গুহার রূপকথায়, যেখানে একটা প্যারাডক্স রয়েছে, তিনি গুহার প্রাচীরের বেঞ্চে বেঁধে রাখা বন্দীদেও বর্ণনা করেছেন যারা দাঁড়িয়ে আছে গুহার দেয়াল মুখী হয়ে। তাদের পেছনে রয়েছে আগুন যা তারা দেখতে পাচ্ছেনা। তারা সামনের দিকটা ছাড়া অন্য কোন দিকে মুখ ঘুরাতে পারছেন না। এবং আগুন ও প্রাচীরের মধ্য দিয়ে চলাচল করা অভিনেতারা তাদের জন্য একটি চিত্র বহন করছে।
সুতরাং, তারা কেবল সেই চিত্রটির ছায়া দেখতে পাচ্ছে। তারা ভাবছে যে, তারা বাস্তবতা দেখছে। কিন্তু মূলত তারা যা দেখছে, তা কোনও চিত্রের, চিত্র ছাড়াআর কিছু নয়। প্লেটো বুঝাতে চেয়েছেন যে, একজন গুহাবাসী যিনি গুহার বাইরে কোনদিন বের হননি, তার কাছে সেই গুহাটাই সম্পূর্ণ পৃথিবী। অনুরূপ আমরাও আমাদের ইন্দ্রিয় গোচরে যা কিছু দেখি, তার ঊর্ধ্বে কিছুই অনুভব করতে পারিনা।

প্লেটোর বিষটি এখানে টানার মূল উদ্দেশ্য হল এই যে, আমাদেরকে ভিন্ন কিছু জানতে হলে, নতুন কিছু আবিকার করতে হলে, আমাদের অবশ্যয়ই জ্ঞানীয় চিন্তাভাবনা, প্রচার-প্রসার এবং অনুসন্ধান অভ্যাহত রাখতে হলে শুধু শিশু নয়, প্রতিটা মানুষকেইএকটা নির্দিষ্ট ধারণার বাহিরে আসতে হবে। প্রশ্ন করার সুযোগ পেতে হবে, অনুসন্ধান করার উৎস থাকতে হবে। আমরা আজীবন প্লেটোর ‘গুহার রূপক’এ বাস করতে থাকলে একটি নির্দিষ্ট বৃত্তেই আমাদের জ্ঞান প্রসারিত হবে, এর বাহিরে আমরা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়দ্বারা বিশ্বকে দেখতে পারবো না, জানতে পারবো না, নতুন কিছু আবিষ্কার করতে পারবো না।

শিশুদের বেলাও অনুরূপ; একজন পিতা-মাতা হিসাবে, আমাদের সবার সন্তানের জন্মের সাথে সাথে তার জ্ঞানীয় বিকাশকে উৎসাহিত করা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটি শিশু সন্তানের স্কুল এবং পরবর্তী জীবনে সাফল্যের ভিত্তি সরবরাহ করে। উদাহরণস্বরূপ, গবেষণা দেখায় যে, ছয় মাস বয়সে যে শিশুরা শব্দের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে বা বুঝে, তারা চার এবং পাঁচ বছর বয়সের মধ্যে পড়তে শেখার দক্ষতা অর্জনে সফল হয়।

 

Link