প্যাসিভ অ্যাগ্রেসিভ শিশুর সঙ্গে আচরণ করা শিখতে হবে

 

 

প্যাসিভ-অ্যাগ্রেশন বলতে, প্যাসিভ অর্থাৎ লুকানো রাগ। যদি শিশুদের অনুভূতিকে দমন করতে এবং অস্বীকার করতে শেখানো হয়,যদি প্রকাশ করার সুযোগ দেয়া না হয়,তাহলে তারা এই প্যাসিভ অ্যাগ্রেশনের কাছাকাছি যাওয়ার উপায়গুলো যেমন, রাগান্বিত হওয়া,গোপন আচরণ, মনযোগ না দেয়া, ভুলে যাওয়া, অস্পষ্টতা, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি ইত্যাদি খুঁজে নেয়।
বেশির ভাগ শিশুর মাঝেই এই প্যাসিভ-অ্যাগ্রেশন প্রবণতা থাকে। এই প্রবণতা দূর করাও সম্ভব। তবে, যদি মা এবং বাবা এই আচরণ বন্ধ করতে সাহায্য না করেন, তবে শিশুরা এভাবেই তাদের পুরো জীবন কাটাতে হয়।

যেমন- আপনি আপনার রান্নাঘরে বা পরিবারে যে কোন কাজে ব্যস্ত আছেন এবং কোন কারণে আপনি আপনার সন্তানকে ডাকছেন। যেমন বলছেন, -এই রাতুল। (আমরা প্রায়শই সন্তানদের ডাকতে গিয়ে শুধু নাম ধরে ডাকি। সম্পূর্ণ বাক্যের ব্যবহার করিনা।)
আপনি তাকে ডাকছেন। কিন্তু সে কোন সাড়া দিচ্ছে না। হয়তো সে অন্য কিছু করায় ব্যস্ত। আপনি আবারো তাকে ডাকলেন, কোন সাড়া নেই। এবার আপনি সামান্য বিরক্ত বা রাগ হয়ে উচ্চকণ্ঠে বললেন, ‘এই রাতুল। এখানে আসো। তোমাকে যে ডাকছি, শুনছ না?’
অবশেষে আপনার সন্তান তার ঘর বা অবস্থান থেকে বেরিয়ে আসল এবং আপনাকে আনন্দদায়ক অভিবাদন জানানোর পরিবর্তে, ‘কী হয়েছে, মা?’ বা ‘কি?’ বলে জবাব দিল।
বাবা-মা হিসেবে অবশ্যই আপনার কাছে সন্তানের এমন বিরক্তিকর সুর ভাল লাগবে না। এমন জবাব শুনে আপনার তখন রক্ত ফুটতে শুরু করবে। কারণ আপনি বুঝতে পারছেন না আপনার সন্তানের এমন বিরক্তি বা রুক্ষ্ম আচরণের কারণ কি।

আপনি নিজেকে জিজ্ঞাসা করতে শুরু করলেন, ‘আমি তার সাথে এমন কী করেছি যাতে সে আমার সাথে এভাবে আচরণ করছে?’ আপনি হয়তো সে সময় নিজ সন্তানের ব্যবহারের সঙ্গে অন্য কারো সন্তানের ব্যবহার তুলনা করতে শুরু করবেন।মন খারাপ হবে। আপনি ভাববেন, ‘এত ভালবাসি তাকে, এত যত্ন করি, তবু কেন এমন ব্যবহার?’

কিন্তু এর একটি সহজ উত্তর হলো, আপনি এই বিশেষ মুহূর্তে কিছুই করেননি। আরো বিস্তারিত উত্তরটি হলো, আপনার সন্তান এখন ক্ষুদ্ধ-রাগান্বিত।সে হয়তো নিজেও জানে না,কেন সে রাগান্বিত বা ক্ষুব্ধ। এখন, বাবা-মা হিসেবে এখানেই আপনাকে ইনভলভ হতে হবে। আপনাকে সন্তানের সমস্যাটি চিনতে হবে, জানতে হবে, খুঁজে বের করতে হবে।এর একটি নাম দিতে হবে।মনোবিজ্ঞানের ভাষায় এই ধরনের সমস্যাটির নাম হলো, প্যাসিভ এ অ্যাগ্রেসিভ বিহেভিয়ার বা প্যাসিভ আক্রমনাত্মক আচরণ।
প্যাসিভ আক্রমনাত্মক আচরণ হলো, প্রতিকূলতার পরোক্ষ অভিব্যক্তি। যেমন- কাজ সম্পন্ন করতে বা সাড়া  দিতে বিলম্ব করা, একগুঁয়েমি ও নিষ্ঠুর আচরণ, মনযোগী না হওয়া, ব্যর্থ হওয়া .. ইত্যাদি। এসব আচরণগুলোর জন্য প্রায়ই স্পষ্টভাবে কেউ না কেউ দায়ী।

তবে, এই আচরণগত সমস্যাটির জন্য আপনার সন্তান অপরাধী নয়। বাবা-মায়ের সামান্য সহযোগিতা পেলে তারা নিজেরাই এই আচরণ থেকে বের হয়ে আসতে পারবে।পিতা-মাতা হিসাবে আমাদের বাচ্চাদের এমন আচরণে  তাদের প্রতি আঙুল তুলার আগে আমাদের একটি স্ব-পরীক্ষা করে নেয়াও গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের নিজেদের জিজ্ঞাসা করা দরকার , আমরা কি সন্তানের কাছে বা সামনে নিষ্ক্রিয়ভাবে এই আক্রমণাত্মক আচরণ প্রদর্শন করছি কিনা। কিংবা, আমরা পরিবারে দাম্পত্য সম্পর্কের বেলায় একে অন্যের প্রতি এমন আচরণ করছি কি?

শিশুরা আমাদের থেকে শেখে। যা পর্যবেক্ষণ করে, তাই ধারণ করে। ধরুন, আপনাদের দাম্পত্য জীবনে কোন সমস্যা হচ্ছে, মতবিরোধ হচ্ছে।এটা নিয়ে তর্ক বিতর্ক হতে পারে। সে সময় আপনার শিশুটি কোন না কোন ভাবে দেখল যে, আপনারা একে অন্যের প্রতি রাগান্বিত বা একে অন্যকে কথা বলার, বোঝার সময় বা সুযোগ দিচ্ছেন না। একচেটিয়া কেবল লড়াই করেই যাচ্ছেন। তখন শিশুটিও সেই কনসেপ্ট ধারণ করার সম্ভাবনাই বেশী রাখবে। শিশুটিও ভেবে নেবে যে, এখানে সবার মতামত বা আবেগ-অনুভূতি গ্রহণযোগ্য নয়, বরং অবহেলিত।

অনেক সময় আমরা মনে করি,শিশু বয়সে কত কী হয়। বাচ্চাদের বয়সের সঙ্গে সব ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু শিশু বয়সের সময়ের সাথে প্যাসিভ আক্রমনাত্মক আচরণটা চলে যাবে, বিষয়টা এমন নয়। এটা একটা অভ্যাস এবং উপায়,যা আপনার শিশু এভাবেই নিজেকে প্রকাশ করতে শিখেছে। এটি আসলে তাদের পক্ষ থেকে একটি নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া।
প্যাসিভ আক্রমনাত্মক আচরণটা প্যাসিভ রেজিস্ট্যান্স তখনই হয়–যখন বাচ্চারা আপনাকে প্রতিরোধ করে আপনার উপর শক্তি বিকাশ করতে শেখে। এটি অ্যাগ্রেশনের বিপরীত।এখানে আপনাকে হুমকি বা চিৎকার করার পরিবর্তে একটি প্যাসিভ-আক্রমনাত্মক শিশু কেবল নীরব থাকবে এবং আপনাকে উত্তর দিবে না।
ধরুণ,আপনি তাকে ডাকছেন। সে তার ঘরে আছে। কিন্তু কোন উত্তর দিচ্ছে না। সে না শোনার ভান করে আছে। বার বার ডাকার পর যখন আপনি কোন সাড়া পাচ্ছেন না, তখন আপনি নিজেই তার ঘরে গেলেন। এখানে শিশুটি মূলত আপনাকে তার ঘরে আসতে বাধ্য করলো। অর্থাৎ তার হাতে ক্ষমতা। এটিই হল একটি শিশুর ক্ষমতা পাওয়ার একটি উপায় এবং এটাই প্যাসিভ রেজিস্ট্যান্স বিহেভিয়ার।

প্যাসিভ অ্যাগ্রেশন বা আক্রমনাত্মক একটি শিশু বা ব্যক্তির ক্ষেত্রেও সরাসরি রাগ প্রকাশের ভয় দ্বারা অনুপ্রাণিত। একজন প্যাসিভ-আক্রমনাত্মক শিশু বা ব্যক্তি অনেক সময় বিশ্বাস করে যে, যদি অন্য লোকেরা তাদের অনুভুতি, রাগের কথা জানতে পারে, তবে খারাপ কিছু হতে পারে।  তাই তারা প্রত্যক্ষ নয়, পরোক্ষ ভাবে রাগ প্রকাশ করে। তারা অন্যদের হতাশ করে প্রকৃত মাধ্যমিক আনন্দ লাভ করে। এই কারণে, অনেকে একে ‘দ্য অ্যাংরি স্মাইল’ বলে থাকেন।

বিশেষজ্ঞদের মতে, প্যাসিভ-আক্রমনাত্মক আচরণগুলোর মধ্যে রয়েছে-  রাগের অনুভূতি অস্বীকার করা বা দমন করা। ভাল-মন্দ জানতে চাইলে উত্তরে ‘আই এম ফাইন,আমি ভালো আছি’ এবং ‘হোয়াটএভার/যাই হোক না কেন’ এর মতো সংক্ষিপ্ত জবাব দেয়া, প্রত্যাহার করা, জবাবে নিরব থাকা, অন্যদের মধ্যে ছোট কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী জ্বালা বোধ তৈরি করা। স্পষ্টভাবে সহযোগী হলেও গোপনে অসহযোগী হওয়া, কোন কাজ নিখুঁতভাবে সম্পাদন করতে দেরি করা, অন্যকে দোষারোপ করা, এড়িয়ে চলা, অনুভূতি গোপন করা, সরাসরি যোগাযোগ এড়াতে ইমেল, টেক্সটিং, সোশ্যাল মিডিয়া এবং অন্যান্য ধরণের প্রযুক্তি ব্যবহার করা, নিজেকে নীরবে অতিমাত্রায় রাগী ব্যক্তির ভূমিকায় ফেলা, এবং চুপচাপ থেকে ব্যক্তি বা পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ করা।

প্যাসিভ অ্যাক্রমনাত্মক আচরণে হয়তো প্রায়ই আপনি সন্তানের মুখে শুনতে পারেন, ‘আমি এটা করতে পারিনি কারণ …,  তুমি যা বলেছ তা আমি শুনিনি। আমিও এটা করেছি, তুমি আমাকে যা বলেছিলে তা করতে ভুলে গেছি। তুমি যা চেয়েছিলেন আমি তা করার চেষ্টা করেছি, কিন্তু আমি জানিনা, তুমি  আসলে কি চাচ্ছো, হ্যাঁ আমি এটা করব, কিন্তু আমাকে আগে আমার কাজটা করতে হবে’….ইত্যাদি।

প্যাসিভ-আক্রমনাত্মক আচরণের সঠিক কারণ জানা নেই। তবে, জৈবিক এবং পরিবেশগত উভয় কারণই প্যাসিভ-আক্রমনাত্মক আচরণের বিকাশে অবদান রাখতে পারে বলে ধারণা করা হয়। গবেষকরা বিশ্বাস করেন যে, যারা প্যাসিভ-আক্রমনাত্মক আচরণ প্রদর্শন করে, তারা শৈশব থেকেই এটি করতে শুরু করে। প্যারেন্টিং স্টাইল, পারিবারিক গতিশীলতা এবং অন্যান্য শৈশব প্রভাবগুলি এর কারণ হতে পারে। শিশু নির্যাতন, অবহেলা এবং কঠোর শাস্তি একজন শিশু বা ব্যক্তির মধ্যে প্যাসিভ-আক্রমনাত্মক আচরণ গড়ে তুলতে পারে। পদার্থের অপব্যবহার এবং কম আত্মসম্মানও এই ধরনের আচরণের দিকে পরিচালিত করে বলে মনে করা হয়।

অন্তর্নিহিত শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থার ফলেও এমন আচরণ হতে পারে যা প্যাসিভ-আক্রমনাত্মক আচরণের অনুরূপ প্রদর্শিত হয় বলে ধারণা করা হয়।
একজন অভিবাবক হিসাবে যদি আপনি বুঝতে পারেন যে আপনার স্কুল-বয়সী শিশুর মধ্যে প্যাসিভ-আক্রমনাত্মক আচরণটি একটি অভ্যাসে পরিণত হচ্ছে, তাহলে এই সমস্যাটি জরুরি ভিত্তিতে মোকাবেলা করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
‘হাউ টু রিয়েলি লাভ ইয়োর অ্যাংরি চাইল্ড’-এর লেখক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডক্টর ক্যাম্পবেল সতর্ক করে বলেছেন যে, শিশুদের মধ্যে প্যাসিভ-আক্রমনাত্মক আচরণ হল রাগ ভাঙ্গানোর জন্য, অভিশাপ দেওয়া, সম্পত্তি ধ্বংস করা, অথবা শারীরিক ও মৌখিক অপব্যবহারের চেয়েও বেশি উদ্বেগজনক কিছু করা। তিনি বলেন, ‘প্যাসিভ আক্রমনাত্মক আচরণ যা ১৭  বছর বয়সের পরেও চলতে থাকে, তা জীবনের জন্য স্থির থাকে।
বাবা -মা হিসেবে আমাদের সবার মাঝেই বক্তৃতা দেওয়ার একটা প্রবণতা রয়েছে। আমরা জীবনের অর্জিত সমস্ত জ্ঞান সন্তানদেরউপর ভাগ করে নিতে চাই বা চাপিয়ে দিতে চাই। সেটা ভিন্ন কথা। তবে পিতা-মাতা হিসাবে আমাদের কাজ হল আমাদের সন্তানদের সঠিক ভাবে গাইড করা। কিন্তু সবকিছুর জন্য একটি সময় এবং পরিস্থিতি রয়েছে। প্যাসিভ আক্রমনাত্মক আচরণের সাথে লড়াই করা সন্তানের জন্য আমাদেরকে আরো ধৈর্য্যশীল ও সহনশীলতার সাথে এগুতে হবে। এ সময় সন্তানের মুখে অনেক কঠিন শব্দ-বাক্যের সাথে নেতিবাচক আচরণে আমরা আহত হতে পারি, সেজন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

আমরা জানি যে, এটা কঠিন হবে কিন্তু সত্যি বলতে সেই মুহুর্তে যখন আপনি সরাসরি প্যাসিভ আক্রমনাত্মক আচরণের শিকার হবেন, তখন আপনার সন্তানকে তার অনুভূতি প্রকাশ করতে উৎসাহিত করতে হবে এবং তাকে সরাসরি কিছু প্রশ্ন করতে পারেন।

যেমন আপনি জিজ্ঞাসা করতে পারেন, তুমি এত রাগ করছ কেন? আমার প্রতি এত রাগ প্রকাশ করার কারণটা কি বলবে? কেন এভাবে আচরণ করছো?

বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই শিশুরা এর সঠিক জবাব দেবে না। তাঁদের সঙ্গে স্পষ্ট আলোচনায় কারণগুলো বেড় করতে হবে। এটা আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে ব্যখ্যা করা।
প্যাসিভ আক্রমণাত্মক শিশুর সাথে আচরণ করা শিখতে হবে আমাদের। আপনার সন্তানের সাথে ইতিবাচকভাবে খোলা আলোচনা অব্যাহত রাখুন। তাকে তার অনুভূতিগুলি প্রকাশ করতে উৎসাহিত করুন, যা তার জন্য উপযুক্ত। তাকে চিৎকার করা এবং রাগ করার অনুমতি দিন। তার রাগে পাল্টা রাগ করবেন না বা তার অনুভূতির অভিব্যক্তি বন্ধ করবেন না। এই পরিস্থিতি কঠিন, তবে ধৈর্য্যের সাথে আপনার নিজেকে শান্ত রাখতে হবে।

আপনার সন্তানকে বুঝতে দিন যে, তার রাগান্মিত আবেগগুলি বুঝতে এবং মোকাবেলা করতে সাহায্য করার জন্য আপনি সেখানে উপস্থিত আছেন। আপনার সন্তানের রাগকে গ্রহণ করুন এবং এর অন্তর্নিহিত কারণগুলো খোঁজে বের করার চেষ্টা করুণ। তারপর নিজে কি সেই রাগের কারণের সাথে সংযুক্ত কিনা, তা ভেবে দেখুন এবং নিজেকেও সংশোধন করার চেষ্টা করুণ। আপনার সন্তানকে বলুন আপনি তার অনুভূতির প্রতি সম্মান রাখেন। আপনার সন্তানের ভাল আচরণের জন্য নিজেও একজন ভাল মডেল হোন। শিশুরা নিজস্ব একটা স্পেস চায় এবং আমাদের তাদেরকে সেই স্পেসটা দিতে হবে।

 

PA LINK