নসিমনের ডায়েরি ০১.



হতাশাঃ

আত্মজীবনী লিখার বিশেষ ক্ষমতা কেবল বিশেষ মানুষদের থাকে। সে ক্ষমতা আমার নেই। আমি বিশেষ কেউ নই। আমি খুব সাধারণ, একেবারেই সাধারণ। অনেকটা শিল্প ও ফুলের মত। “A work of art is useless as a flower is useless”- যে কোন শিল্প উদ্দেশ্যহীন, কারণ এর উদ্দেশ্য কেবল একটি ভাব তৈরি করা। এটি কোন ভাবেই কারো কর্মকে প্রভাবিত করেনা।
ফুল শুধুই নিজের জন্য ফুটে। তার নিজের আনন্দের জন্য ফুটে। আমরা এটি দেখার মাধ্যমে একটি আনন্দঘন মুহূর্ত লাভ করি। ফুলের সাথে আমাদের সম্পর্ক কেবল দেখার, অনুভব করার। ফুল বা শিল্প আমাদের প্রভাবিত করে; আন্দোলিত করেনা।

আত্মজীবনী লিখা দুঃসাহসের কাজ। কোন বিশেষ ব্যক্তিও যে সম্পূর্ণরুপে নিজেকে জীবনীর মাধ্যমে প্রকাশ করতে পেরেছেন, সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে। কে চায় নিজের অক্ষমতা বা অপরাধ বেড়িয়ে আসুক প্রকাশ্যে? যারাই আত্মজীবনী লিখেছেন, তারা সকলেই কৌশলে চরম সত্যকে আড়াল করে গেছেন। আর আমি তো সে অর্থে খুবই সাধারণ! এমন দুঃসাহস করার ক্ষমতা আমার নেই।
সত্যের অন্বেষণে বহু জ্ঞানী-গুনি কবি সাহিত্যিকের পঙ্তি রচনাকে আমরা নানানভাবে বিশ্লেষন করে থাকি। কখনো বোধে, কখনো অর্থালঙ্কারে সিদ্ধান্তে উপনিত হই। কিন্তু কবির ভাষার নির্দিষ্ট কোন তাৎপর্য খুঁজে পেতে আমরা অনেক সময় ব্যর্থ হই। শুধুমাত্র কবিই বলতে পারেন তার ভাষার অন্তরনিহিত তাৎপর্য!

আমি কবি নই। আমি অতি সাধারণ একজন মানুষ। মানুষ হওয়ার সকল উপকরণ আমার মধ্যে বিদ্যমান। হাত, পা, চোখ, মুখ, অনুভুতি, আবেগ, রাগ, হিংসা, ঘৃণা, লোভ, বিবেক….সব মিলিয়ে আমি মানুষ। যদি বলা হয় মানুষ শব্দের ব্যাখা এ নয়, মানুষ আরো উপরে মহৎ কিছু, মানবিক ও নৈতিক গুনাবলী সংযোজন না হলে কেউ মানুষ বলে বিবেচিত হবেনা, তবে প্রশ্ন জাগে মনে, মানুষের ভিতর কেবল “মানুষ” হওয়ার উপকরণ দিয়েই তিনি পাঠালেন না কেন? কেন তবে পাওয়ার লোভ জাগে, হারানোর ব্যথায় মুমূর্ষ হই আমরা? কেন কারো বুকে প্রাপ্তির নিঃশ্বাসে আমাদের বুক ভেঙ্গে অপ্রাপ্তির ঢেকুর উঠে?
আমরা মানুষ বলেই অনৈতিক হই! মানুষ বলেই লোভী হই, ঈর্শান্বিত হই। মানুষ বলেই বুকে ব্যাথা অনুভব হয়; চোখে পানি আসে। ফেরেশতাদের চোখে পানি আসেনা! তারা মনূষ্যকূলের উর্ধ্বে।

খাতা টেনে মাঝে মাঝে হিজিবিজি লিখি। কি লিখি নিজেরই বোধগম্য নয়। হতে পারে তড়িৎ কষ্ট, কিংবা তৎক্ষনাৎ মোহ! কবিদের মত কলমের ঝংকারে জীবনের নানান দিক ঈঙ্গিত করা আমার কাজ নয়, আমি অতি সাধারণ। সাধারণ মানুষ হয় সস্তা গদ্যের মত; কাবিক পদ্যে রুপকের জন্ম দিতে তারা ব্যর্থ। ভেঙ্গে পড়তে পড়তে খাতা টেনে যখন আমি লিখি, “ভালবাসা কি আমি বুঝিনা! ভালবাসার সংজ্ঞাও জানা নেই! শুধু জানি, ভুল ব্যকরণে গুলিয়ে যায় শেষ রাতের কাব্যিক দৃশ্যপট। মেদহীন খাঁজকাটা শরীরে তোমাকে ধারণ করার লিপ্সায় সুগন্ধি রুমাল বুকে গুজে দিতে গিয়ে দেখি; বুকের গহীনে জমে আছে বরফবৃষ্টি”, তখন আমি ভীরু মগজে শুধুই আত্মজীবনের গোপন কুঠুরিতে বন্ধি একটি দীর্ঘশ্বাসকে মুক্ত করি। কোন প্রতিক্রীয়া ছাড়াই। কিন্তু যখন আমার প্রিয় কবি তাতে লাইন সংযোজন করে বলেন,
“ছন্নছাড়া মন হেঁটে যায় একা উদ্দেশ্যহীন, কেন জানিনা।
শুধু জানি, ভালবাসাহীন অরণ্যে তোমাকে ছোঁয়ার ব্যকুলতায়, বিরহ ছুঁয়ে জোৎস্না রাতে এই চোখ অকারণে কাঁদে”, তখন আবার বন্ধ কুঠুরিতে আমি ফুঁপিয়ে কাঁদি। সাধারণ বলেই কাঁদি!

সমরেশ তার আঁট কুঠুরিতে নয় দরজার কথা বলেছেন। তিনি জ্ঞানী বিজ্ঞ লোক, তার বিশ্লেষণ ব্যপক! অত জ্ঞানের ভাষা ধারণ করার ক্ষমতা আমার নেই। আমি বলি, আমার এক কুঠুরিতে নয় দরজা! সেখানের দরজাগুলো বন্ধ বলেই মৃত্যু অবধারিত মনে হয়! মনে হয় বহুদিন গায়ে আলো স্পর্শ করেনি! বহুদিন কারো স্পর্শে নিশিতে জেগে উঠিনি।ব্যাকুল হয়ে বলিনি; আমায় ঘুম পারিয়ে দাও।

সত্য বলার সাহস আমার কখনো হবেনা। তাই নিজেকে আজকাল বড় বেশী অসৎ মনে হয়! মনে হয় বড় চতুরতায় নিজেকে আড়াল করে রাখছি! এই যে ক্ষুধা নিয়ে ঘুমাতে যাই, খাওয়ার কথা বলতে পারিনা! ব্যথায় পাঁজরের নীচে ফাটল ধরে, কাউকে দেখাতে পারিনা! মধ্যরাতে পাশের ঘরে সরলার অস্ফূট গোঙ্গানীতে খিলখিয়ে হেসে উঠায় কোথায় যে টান পড়ে…. সে কথা বলতে পারিনা! এত কপটতা, এত ভন্ডামি আছে বলেই আমি মানুষ!

আজকাল মাথার ভিতর থেকে ঘুন পোকা অসুখটা বের হতে চায়না। সারাক্ষন ওরা আমার মগজ কুটকুট করে খায়! আমি ঘাপ্টি মেরে পড়ে থাকি বিছানায়! নড়ে উঠলেই ওরা থেমে যাবে!
তৃপ্তিতে খেয়ে যাক ওরা আমার মগজ। কেউ ক্ষুধায় না মরুক! পৃথিবীর সবার ক্ষুধা নিবারণ হোক। ক্ষুধা এক ভয়ানক জৈবিক চাহিদা বা বলা যায় প্রতিক্রিয়াশীল মন ও শারীরিক আবেগ, যা পৃথিবীর সমস্তকিছুকে অসংলগ্ন ও মিথ্যা করে দেয়।

ক্ষুধা মানুষের সুকুমারবৃত্তি চর্চার সূক্ষ্মবোধকে নষ্ট করে ফেলে। ক্ষুধার যন্ত্রণা মানুষের মননশীলতা নষ্ট করে দেয়। সভ্যতার সৃষ্টিলগ্ন থেকেই ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য নিরন্তন সংগ্রাম করে চলেছে মানুষ। কখনও নিজের সাথে, কখনো প্রকৃতির সাথে। ক্ষুধা নিয়ে সৌন্দর্য চর্চা হয়না, পৃথিবীর রূপ আস্বাদন হয়না। ক্ষুধার অসহ্য যন্ত্রণায় তলিয়ে যেতে যেতেও আমরা ক্ষুধার কথা বলিনা। আমরা বড় ছদ্মবেশী।