দলীয় ও রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতায় তুফান সরকার

ক্ষমতার সঙ্গে অপরাধের একটি নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। ক্ষমতাবান হলে অপরাধ করা সহজ এবং নিরাপদ। বাংলাদেশের ইতিহাসে যখন যে সরকার এসেছেন, তখন সে দলের লোকজনদের অপরাধ করার রেকর্ড বেশি দেখা যায়।

বগুড়ার এক কিশোরীকে কলেজে ভর্তির প্রলোভন দেখিয়ে ১৭ জুলাই ও পরে কয়েকবার ধর্ষণ করে শহর শ্রমিক লীগের আহ্বায়ক তুফান সরকার বর্তমানে শুধু বগুড়া নয়, পুরো দেশে আলোচনার ঝড় তুলেছেন। সেই সাথে একদল সন্ত্রাসী দ্বারা তুলে নিয়ে শুক্রবার দুপুরে ওই কিশোরী এবং তার মাকে মারধর করে নাপিত দিয়ে মাথা ন্যাড়া করে দিয়ে তুফানের স্ত্রী আশা ও তার বড় বোন বগুড়া পৌরসভার সংরক্ষিত মহিলা ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মার্জিয়া হাসান রুমকি চলে এসেছেন আলোচনায়।

কে এই তুফীন সরকারঃ
——————-
বগুড়া শহরের চকসুত্রাপুর কসাইপাড়া এলাকার মজিবর রহমানের ছেলে তুফান সরকার। তার রাজনৈতিক পরিচয় হল, সে বগুড়া শ্রমিক লীগের নেতা। তার বড় ভাই বগুড়া শহর যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মতিন সরকার। স্ত্রীর বড় বোন স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর।
বড় ভাইয়ের হাত ধরে ২০১৫ তে বগুড়া আওয়ামী শ্রমিক লীগে যোগ দান করেন তুফান। তুফানের উত্থান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর। বগুড়ায় জুয়ার আসর দিয়ে তার অবৈধ আয়ের যাত্রা শুরু। এরপর মাদক ব্যবসা।
বড় ভাইয়ের সুবাদে একসময় তিনি শহর শ্রমিক লীগের সভাপতি হয়ে যান। এরপর শুরু হয় ব্যাটারিচালিত রিকশার লাইসেন্স ব্যবসা। ব্যাটারিচালিত এসব রিকশা রাস্তায় নামানোর আগে প্রতিটির জন্য ২ হাজার ৫০০ টাকা নজরানা দিতে হয় তুফানকে। বগুড়া শহরে বর্তমানে ২০ হাজার ব্যাটরিচালিত রিকশা চলছে। এই হিসাবে মোট চাঁদা দাঁড়ায় ৫ কোটি টাকা।
এ ছাড়া প্রতিদিন এসব রিকশা থেকে ৩০ টাকা করে চাঁদা তোলা হয়। এতে গড়ে প্রতিদিন ১০ হাজার রিকশা থেকে তিন লাখ টাকা চাঁদা তুফানের দরবারে চলে যায়।
তুফান বাহিনী’র প্রধান তুফানের বিরুদ্ধে শহরের বিভিন্ন স্থানে জায়গা-জমি এবং দোকান-পাট দখলেরও বহু অভিযোগ রয়েছে। ২০১২ সাল থেকে এ পর্যন্ত হত্যা, হত্যাচেষ্টা, মাদক ব্যবসা ও চোরাচালানের ছয়টি মামলার আসামি এই তুফান সরকার।
পরিবহন সেক্টরে চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে মাদক ব্যবসা, দখলবাজি ও বাণিজ্যমেলায় জুয়ার আসর বসিয়ে টাকা কামিয়েছেন দুই হাতে। তিনি এখন কোটি কোটি টাকার মালিক। বাবা মজিবর রহমান রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করলেও তার ছেলে তুফান থাকেন বিলাসবহুল বাড়িতে, চড়েন দামি গাড়িতে।
ক্ষমতাসীন দলের ছত্রচ্ছায়ায় থেকে ছয় বছরে গাড়ি, বাড়ি, ব্যবসা–প্রতিষ্ঠানসহ অঢেল সম্পদের মালিক বনেছেন তুফান সরকার। টাকার বিনিময়ে প্রশাসন আর নেতাদের হাতে রেখেছেন। যার কারণে প্রকাশ্য এসব চাঁদা আদায় করলেও তুফানের বিরুদ্ধে কেউ কোনো কথা বলার সাহস দেখায়নি। পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনও নিশ্চুপ তার নানা অপকর্মের বিষয়ে। ফলে বেপরোয়াভাবে নানা অন্যায়-অপকর্ম করে বেড়াচ্ছিল তুফান। এখন যখন ধর্ষণের বিষয়টি মিডিয়া ও সামাজিক মাধ্যমগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে, তখন বগুড়া শাখার পুলিস প্রশাসনের টনক নড়ে।

উদাসীন রাজনীতিতে সরকার ও ক্ষমতার অপব্যবহারঃ
——————————————–
তুফান সরকারের কীর্তিনামা সম্পর্কে বগুড়াবাসী ও বগুড়া লীগ প্রশাসন জ্ঞাত থাকলেও দেশের আপাময় জনসাধারণ ছিলেন অজ্ঞাত। ২০১২ সাল থেকে এ পর্যন্ত তুফান সরকারের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ছয়টি। এগুলোর মধ্যে রয়েছে হত্যা, হত্যাচেষ্টা, মাদক ব্যবসা ও চোরাচালান মামলা। ২০১৫ সালে তুফান সরকারকে তার বাসা থেকে কয়েকশ’ বোতল ফেনসিডিলসহ গ্রেপ্তার করা হয়। এর আগে ২০১৩ সালে যুবদলের এক নেতা ইমরান হত্যা মামলার আসামিও তিনি।
সাধারণ জনগন না হয় তুফান সরকারের অপকর্মের কথা জানতেননা, কিন্তু সে যে দীর্ঘদিন ধরেই মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসের সাথে জড়িত, সেটা তো স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা জানতেন। পুলিশ ও প্রশাসন ঘটনাগুলো জানতেন। তবে কিভাবে ফেন্সিডিলসহ আটক হওয়া তুফান সরকার বগুড়া মহানগর শ্রমিক লীগের আহবায়কের পদ পায়? তার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ কমিটি ও প্রশাসন কেন কোন ব্যবস্থা নেয়নি এতদিন? আজ লীগের বড় বড় নেতারা মিডিয়ার ক্যামেরার সামনে ভাষণ দিচ্ছেন, “কেউ ছাড়া পাবেনা, অপরাধী যে দলেরই হোক, উপযুক্ত শাস্তি পাবে!” কোথায় ছিলেন এতদিন বগুড়া শহর যুবলীগ কমিটি ও কেন্দ্রীয় নেতারা?

শুধু তুফান সরকার নন, তার বড় ভাই মতিন সরকারও শহর যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। তিনি রেবের তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ী। সদর থানায় তার নামেও ছয়টি মামলা আছে। একটি মামলায় তার ২৭ বছরের সাজা হলেও উচ্চ আদালতের আদেশে সাজাটি এখন স্থগিত আছে।

আওয়ামী লীগ অঙ্গ সংগঠনের নেতারা নিজেদের আইন, আদালত, ও বিচার সবকিছুর উর্ধ্বে ভাবতে শুরু করেছে। সরকারি দলের ছত্রছায়ায় থেকে তুফানের মত হাজারো সন্ত্রাসীদের রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যান। এই কলাগাছদের খবর কি কেন্দ্র বা সরকার রাখেন না? নাকি ক্ষমতা টিকাতে সরকার তুফানদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেন? ক্ষমতায় টিকে থাকতে হলে এই শীর্ষ সন্ত্রাসীরাই কি তবে সরকারের জন্য সোনার ডিম পারা হাঁস?
খালি উন্নয়ন আর বিদ্যুৎ দিয়ে নির্বাচনী প্রচার করে পার পাওয়া যাবে না। আইনের সুশাসন নিশ্চিত করতে না পারলে মাষ্টারমাইন্ড প্রক্রীয়ায় আওয়ামীলীগ সরকার বেশীদিন ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবেন বলে মনে হয়না।

মেয়েটির কি হবে?
——————–
সারা দেশ যখন তুফানবেগে তুফান সরকারকে নিয়ে ভাবছেন, তখন আমি ভাবছি মেয়েটির কথা। সবে এসএসসি পাস করেছে মেয়ে মেয়েটি। স্বপ্ন ছিল ভালো একটি কলেজে ভর্তি হবে। তুফান সরকারের অনেক ক্ষমতা জেনেই প্রতিবেশী আজিম দিপুর মাধ্যমে তুফানের দারস্থ্য হয় সে। কিন্তু এই তুফানই যে তার জীবন লন্ডভন্ড করে দিবে, কে জানতো!
মেয়েটির বাবা গ্রামীণ বাজারে সামান্য পুঁজির ব্যবসা করেন। মা ঢাকায় পোশাক কারখানার শ্রমিক। ঢাকাতেই থাকত তার মা। মেয়েটি নানির বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করত। কিছুদিন আগে মা বগুড়ায় ফিরে গেলে সে তার মা-বাবার সঙ্গে থাকতে বগুড়ামূখী হয়।
কলেজে ভর্তির কথা বলে একটি কিশোরী মেয়েকে বাড়ী ডেকে নিয়ে দিনভর আটকে রেখে দফায় দফায় ধর্ষণ করা, আবার বিষয়টি কাউকে না বলার জন্য ভয়ভীতি দেখানো, মা-মেয়েকে পূনরায় সন্ত্রাসী দিয়ে মারধোর করে মাথা ন্যাড়া করে দেয়া, কতটা পশুত্বের পরিচয় বহন করে!
তুফান সরকার আজ নয় তো কাল দলীয় কৌশলে ঠিকই বের হয়ে যাবে, কিন্তু মেয়েটির কি হবে? তার ভবিষ্যত? কে নেবে মেয়েটিকে ঘরে তুলে? সবাই আফসোস করা পর্যন্তই। মেয়েটির স্বপ্ন, স্বতীত্ব ও ভবিষ্যত ফিরিয়ে দেয়ার ক্ষমতা আছে কারো? ব্যক্তি-সমাজ-সরকার…. কে নেবে তার দায়ীত্ব? তারপরও কথা থেকে যায়! মানসিকভাবে মেয়েটি যে দুর্যোগের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, ভয়ানক দুঃসহ যে যন্ত্রণা তাকে তিলতিল করে মারছে, এর প্রতিকার আছে কি? নেই। যার যায়, সেই বোঝে!
ধর্ষণ এখন একটি স্যোসাল ভাইরাস। তার মত অসংখ্য মেয়েরা রোজ কতিপয় পুরুষ দ্বারা এ ভাইরাসে আক্রান্ত। সরকার আইন সংশোধন করেন নিজ প্রয়োজনে। “ধর্ষণের পর হত্যার শাস্তি একমাত্র মৃত্যুদন্ড” এমন বিধান দিয়ে ১৯৯৫ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের তিনটি ধারাকে অসাংবিধানিক মেনে, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ২০০০ সালে আইনটিতে নতুন ধারা যোগ করেন। সে আইনে ধর্ষণ ও হত্যার সাজা মৃত্যুদন্ডের পাশাপাশি যাবজ্জীবনের বিধানও রাখা হয়।
আইনজীবিদের ভাষ্যমতে, “কোনো অপরাধেরই একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হতে পারে না। অপরাধের ধরন অনুযায়ী অন্য শাস্তিও হতে পারে। দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ করলে কেউ কম অপরাধী, আবার কেউ বেশি অপরাধীও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে সবাইকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া সংবিধান পরিপন্থী। কারণ, অপরাধের ধরন অনুযায়ী সাজা কম বা বেশি হতে পারে।”

এই ব্যখ্যা ও বিশ্লেষণ বোধগম্য নয়। প্রথমতঃ কেবল ধর্ষণ করে হত্যা করলেই কেন মৃত্যুদন্ড হবে? ধর্ষণের বিচার পেতে তবে কি ধর্ষিতার মৃত্যু আবশ্যকীয়? দ্বিতীয়তঃ দলবদ্ধভাবে ধর্ষণের ক্ষেত্রে কে কম ধর্ষণ করলো, কে বেশী করলো, সেটা পরিমাপ করার জন্য কি ধর্ষিতাকে আবারে মৌখিক ধর্ষণ হতে হবে? নাকি কবর খুঁজে ধর্ষিতার নগ্ন যৌনাঙ্গ ঘোঁটাঘাটি করা হবে?

বিকৃত সমাজ ও রাষ্ট্রের বিকৃত ভাবনায় মাঝে মাঝে মনে হয়, নারায়নগন্জের ৯ মাসের শিশু জান্নাতুলের বাবার মত দেশের সকল বাবারা যদি জন্মের পর তাদের কন্যা সন্তানকে গায়ে আগুন ধরিয়ে মেরে ফেলতেন, তবে বোধহয় মেয়েগুলে বেঁচে যেত।

______HB Rita