শারীরিক এবং মানসিক সুস্থ্যতা আমাদের প্রত্যকের জন্যই খুব জরুরি। তবে অসুস্থ্যতাকেও আমরা এড়িয়ে যেতে পারি না। সুস্থ্যতা নিয়ে আমাদের আগমন ঘটলেও সময়, ঘটনা, দুর্ঘটনা, জেনেটিক বা বয়সের কারণে আমাদের শরীর ও মনে অসুস্থতা জায়গা দখল করে নেয়, আমরা সম্মুখীন হই নানান বাধাগ্রস্থ্য অবস্থা, অক্ষমতা ও প্রতিবন্ধকতার। আমরা কেউ দৌড়ঝাঁপ করতে পারি, কেউ খুঁড়িয়ে হাঁটতে পারি, আবার কেউ পা ছাড়াই বেঁচে থাকি। এই বাধাগ্রস্থ্য অবস্থা, অক্ষমতা ও প্রতিবন্ধকতা শরীর ও মনের এমন একটি অবস্থা বা অক্ষমতা, যা এই অবস্থায় থাকা ব্যক্তির জন্য কিছু ক্রিয়াকলাপ সীমাবদ্ধ করে দেয় এবং চারপাশের ও বিশ্বের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করা আরও কঠিন করে তোলে।
ত্রুটি বা বাধাগ্রস্ত অবস্থা(Impairment), অক্ষমতা(Disability), প্রতিবন্ধী(Handicape) শব্দগুলো যদিও প্রায়শই বিনিময়যোগ্যভাবে ব্যবহৃত হয়, তবে তাদের মধ্যে ভিন্ন অর্থ রয়েছে। ১৯৮০ সালে WHO ত্রুটি বা বাধাগ্রস্ত অবস্থা, অক্ষমতা, ও প্রতিবন্ধী টার্মসগুলোকে ‘The International Classification of Impairments, Disabilities, and Handicaps’গ্রন্থে সংজ্ঞায়িত করেছে ভিন্নভাবে।
ত্রুটি বা বাধাগ্রস্ত অবস্থা(Impairment) বলতে, শারীরবৃত্তীয়, মনস্তাত্ত্বিক বা এনাটোমিক্যাল গঠন বা ফাংশনের কোনো ক্ষতি বা অস্বাভাবিকতাকে বুঝায়,অর্থাৎ, একজন ব্যক্তির শরীরের গঠন বা কাজ বা মানসিক কার্যকারিতার অনুপস্থিতি বা উল্লেখযোগ্য পার্থক্য। ত্রুটি বা বাধাগ্রস্ত অবস্থা স্থায়ী বা অস্থায়ী হতে পারে, তবে সামগ্রিকভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে না।
অক্ষমতা(Disability), যা ত্রুটি বা বাধাগ্রস্ত অবস্থার পরিণতি প্রতিফলিত করে, অর্থাৎ কোন একজন ব্যক্তি যদি তার সমবয়সী অন্য ব্যক্তিদের মত স্বাভাবিক কাজগুলো সম্পন্ন করতে না পারে, কিংবা তা করতে গিয়ে ব্যক্তির ক্ষমতার অভাব ঘটলে, বা বাঁধা পেলে, ঐ ব্যক্তিকে অক্ষম বলা হয়। তবে, অক্ষমতা চিকিৎসার মাধ্যমে কমিয়ে আনা যায়।
প্রতিবন্ধী(Handicape) ত্রুটি বা বাধাগ্রস্ত অবস্থা এবং অক্ষমতার অভিজ্ঞ অসুবিধাগুলির কারণে, ব্যক্তির পক্ষে প্রযোজ্য কোন কাজ করতে সীমাবদ্ধতা টানলে বা ব্যক্তি অপারগ হলে, ঐ ব্যক্তিকে প্রতিবন্ধী বলা হবে।
এমোরি ইউনিভার্সিটির ফলিত উন্নয়নমূলক মনোবিজ্ঞানী শিনা এল কার্টার( Sheena L. Carter, Ph.D) তার
med.emory.edu পোর্টালের ‘Impairment, Disability and Handicap’ আর্টিক্যালটিতে একটি সুন্দর উদাহরণ টেনেছেন।
যেমন ধরুন- পাঁচ বছর বয়সী রাতুলের সেরিব্রাল পালসি(CP)নামক স্পাস্টিক ডিপ্লেজিয়া(spastic diplegia) রয়েছে। রাতুলের সিপি’র কারণে তার পা শক্ত,আঁট থাকে এবং নড়াচড়া করা কঠিন হয়ে উঠে।। সে দাঁড়াতে বা হাঁটতে পারে না।
এখানে, জয়েন্টগুলোতে পা সহজে নাড়াতে না পারা এবং পায়ের উপর ওজন বহন করতে না পারা একটি ত্রুটি বা বাধাগ্রস্ত অবস্থা অর্থাৎ Impairment।অস্বাভাবিকভাবে সংকুচিত পেশীগুলিকে মুক্ত করার জন্য অর্থোটিক্স এবং সার্জারি না হলে, রাতুলের দুর্বলতার মাত্রা বাড়তে পারে, কারণ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ভারসাম্যহীন পেশী সংকোচনের ফলে নিতম্বের স্থানচ্যুতি হয় এবং বিকৃত হাড়ের বৃদ্ধি হতে পারে। রাতুলের দুর্বলতা কমানোর জন্য বর্তমানে কোনো চিকিৎসা উপলব্ধ নাও হতে পারে।
এই উদাহরণে রাতুলের হাঁটতে না পারাটা একটা অক্ষমতা অর্থাৎ Disability. এই ক্ষেত্রে ফিজিক্যাল থেরাপি এবং বিশেষ সরঞ্জাম দিয়ে তার অক্ষমতার মাত্রা উন্নত করা যেতে পারে। যেমন ধরুণ, যদি সে ব্রেসেস সহ ওয়াকার ব্যবহার করতে শেখে, তবে তার অক্ষমতার স্তরের উন্নতি হতে পারে।
রাতুলের সেরিব্রাল পলসি তার মধ্যে এমন একটি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে, যার ফলে সে বাড়িতে, স্কুলে এবং সমাজের অনন্য কাজে স্বাভাবিক ভূমিকা পালন করতে পারছে না। স্কুলের শুরুর বছরগুলোতে তার প্রতিবন্ধকতার স্তরটি খুব হালকা ছিল, যার দরুণ সে অন্যান্য শিশুদের সাথে খেলতে পারতো, পরিবার বা বাইরের যোগাযোগ স্থাপন,পারিবারিক ও সম্প্রদায়ের ক্রিয়াকলাপে সম্পূর্ণভাবে অংশগ্রহণ করতে সক্ষম হতে পারতো। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে তার প্রতিবন্ধকতা বাড়তে থাকবে, এবং যেখানে কিছু খেলাধুলা এবং শারীরিক ক্রিয়াকলাপ একই বয়সের শিশুদের জন্য স্বাভাবিক কার্যকলাপ হিসাবে বিবেচিত হবে, সেগুলি তার জন্য কঠিন হবে। বর্তমানে প্রিস্কুল শ্রেণীকক্ষে রাতুলের যে সামান্য প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, যার জন্য শ্রেণীকক্ষ এবং শ্রেণীকক্ষের বাইরে তার কাজগুলো সম্পন্ন করতে কিছু সহায়তা প্রয়োজন। যেমন, ওয়াকার, সহকারী, কেইন বা হুইন চেয়ার। এটাই রাতুলের প্রতিবন্ধীত্ব।
এক্ষেত্রে যথোপযুক্ত পরিষেবা এবং সরঞ্জাম সেরিব্রাল পলসি রাতুলের বৃদ্ধির সাথে সাথে, তাকে বাড়ি,স্কুল এবং সম্প্রদায়ের প্রতি স্বাভাবিক ভূমিকা পালন করতে সহায়তা করবে।
এই সংজ্ঞাগুলির উপর ভিত্তি করে এটি ধারণা করা যায় যে, ত্রুটি বা বাধাগ্রস্ত অবস্থা এবং অক্ষমতা প্রতিবন্ধীত্ব নয়, এবং প্রতিবন্ধীত্ব একজন ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য নয়, বরং এটি ব্যক্তি এবং পরিবেশের মধ্যে সম্পর্কের বর্ণনা করে। আরো সহজভাবে বলতে গেলে, কোন ব্যক্তির অন্ধত্ব নিয়ে জন্মানো ত্রুটি বা বাধাগ্রস্ত অবস্থা(Impairment), অন্ধত্বের কারণে ব্যক্তির চোখ মেলে অন্যদের মত কোন বই বা পত্রিকা পড়তে না পারা ব্যক্তির অক্ষমতা(Disability), এবং ব্যক্তির অন্ধত্ব ও পড়তে না পারার কারণে যদি ব্যক্তি কোন স্কুলে যোগদান করতে না পারেন, তবে সেটা ব্যক্তির প্রতিবন্ধীত্ব বা প্রতিবন্ধকতা।
তবে, এই ব্যক্তি কিছু সহায়ক প্রযুক্তির ব্যবহার করে দৈনন্দিন কার্যকলাপ (পড়া) করতে সক্ষম হতে পারেন এবং এই প্রতিবন্ধকতা কিছুটা কাটিয়ে উঠতে পারেন।
প্রতিবন্ধকতাকে একজন ব্যক্তির বিপরীতে, পরিবেশের জন্য দায়ী করা হয়। কার্যকরী সীমাবদ্ধতার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করার বিপরীতে, কার্যকরী ফলাফল তৈরি করতে প্রযুক্তি ও পদ্ধতির ব্যবহার করার উপর জোর দেওয়া হয়।
ত্রুটি বা বাধাগ্রস্ত অবস্থা, অক্ষমতা ও প্রতিবন্ধীর ভিন্ন অর্থ রয়েছে
4 Comments
Published by HB Rita on Sunday, November 14th, 2021