উদ্বেগ শরীর ও মনকে ক্ষতিগ্রস্ত

উদ্বেগ শরীর ও মনকে ক্ষতিগ্রস্ত

নিত্য চলার পথে কম বেশি সবাই ভয়, উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তায় থাকি। ছোট ছোট বিষয় নিয়েও আবেগী হয়ে উঠি, আতঙ্কিত হই। কখনো এসব আমাদের বিরাট ক্ষতি করে, আবার কখনো সামনে এগোতে সহায়তা করে।

অডিয়েন্স বা ক্যামেরার সামনে কথা বলা আমাদের উদ্বিগ্ন করে তুলতে পারে, কিন্তু সেই উদ্বেগ আমাদের প্রস্তুতি ও অনুশীলনেও অনুপ্রাণিত করতে পারে। হাইওয়েতে গাড়ি চালানো বা কোনো দুর্ঘটনার পর আবারও ড্রাইভিং সিটে বসা কারও জন্য দুশ্চিন্তার আরেকটি সাধারণ উৎস। কিন্তু এটি দুর্ঘটনা এড়াতে আমাদের আরও সতর্ক থাকতে সাহায্য করতে পারে। চাকরির ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে হাত, শরীর কাঁপতে থাকাও দুশ্চিন্তার একটি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।

তবে, ভয় ও উদ্বেগের অনুভূতিগুলি যখন অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে এবং আমাদের দৈনন্দিন কাজকর্ম করতে বাধাগ্রস্ত করে, তখন সেটি অ্যাংজাইটি বা উদ্বেগ ব্যাধিতে পরিণত হয়। উদ্বেগজনিত ব্যাধি কোনো আপাত কারণ ছাড়াই অতিরিক্ত ভয় বা প্রদত্ত পরিস্থিতি মোকাবিলায় সম্পূর্ণ অক্ষমতার কারণ হতে পারে।

উদ্বেগ আমাদের চাপের একটি স্বাভাবিক আবেগগত প্রতিক্রিয়া। উদ্বেগের সঙ্গে ভয় সম্পৃক্ত। তবে, উদ্বেগ আমাদের বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করে এবং অনেক ক্ষেত্রে আমাদের পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে প্রস্তুত করে। উদ্বেগজনিত ব্যাধিগুলো স্নায়বিক বা উদ্বেগের স্বাভাবিক অনুভূতির থেকে আলাদা এবং এতে অতিরিক্ত ভয় বা উদ্বেগ জড়িত থাকে। উদ্বেগজনিত ব্যাধি মানসিক ব্যাধিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ একটি। আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, এটি প্রায় ৩০ শতাংশ প্রাপ্ত বয়স্কদের জীবনের কোনো না কোনো সময় প্রভাবিত করে।

উদ্বেগজনিত ব্যাধিগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে সাধারণ মানসিক সংকটের একটি। অ্যাংজাইটি অ্যান্ড ডিপ্রেশন অ্যাসোসিয়েশন অব আমেরিকার (এডিএএ) তথ্য অনুযায়ী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৪০ মিলিয়ন প্রাপ্ত বয়স্কদের এই উদ্বেগ প্রভাবিত করে।

উদ্বেগজনিত ব্যাধি চিকিৎসায় নিরাময়যোগ্য। তবে, ভুক্তভোগীদের মধ্যে মাত্র ৩৬ দশমিক ৯ শতাংশ লোক চিকিৎসা পায়। এই অসুস্থতায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার সম্ভাবনা বর্তমানে তিন থেকে পাঁচগুণ বেশি এবং মানসিক রোগের জন্য হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সম্ভাবনা ছয়গুণ বেশি বেড়েছে।

উদ্বেগজনিত ব্যাধি ১৩ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে ২৫ দশমিক ১ শতাংশ শিশু-কিশোরদের প্রভাবিত করে। গবেষণায় দেখা গেছে, উদ্বেগজনিত রোগে আক্রান্ত শিশুরা চিকিৎসা-যত্ন না পেলে স্কুলে খারাপ ফল করে। তারা গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক যোগাযোগ ও অভিজ্ঞতা থেকে দূরে থাকে এবং মাদকদ্রব্যের অপব্যবহারের জন্য বেশি ঝুঁকিতে থাকে।

উদ্বেগজনিত ব্যাধির সব থেকে ক্ষতিগ্রস্ত উপসর্গ হলো ভয় ও আতঙ্ক। ধরুন, আপনি শারীরিক অসুস্থতার কারণে দীর্ঘ দিন ছুটিতে। এখন আপনাকে কাজে ফিরে যেতে হবে। কিন্তু আপনি ভয় পাচ্ছেন। ভাবছেন, শারীরিক কিছু সমস্যা নিয়ে দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারবেন কিনা। ভয় নিয়েই আপনি কাজে যোগ দিলেন। যোগ দিয়েও আপনি একই ভয়ে আছেন। ভাবছেন, আপনি পড়ে গেলেন কিনা, কেউ আপনার ধীর গতিতে কাজ করা লক্ষ্য করছে কিনা, আপনার দিকে বাঁকা চোখে তাকাচ্ছে কিনা ইত্যাদি। একটা সময় এমন ভাবতে ভাবতে আপনার হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল, আপনার নিশ্বাস নিতে কষ্ট হলো, আপনি ঘামতে শুরু করলেন অবশেষে আপনি জ্ঞান হারালেন বা মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন। এতে আপনি হয়তো চাকরিটাও হারাতে পারেন এবং মারাত্মক শারীরিক ও মানসিক সংকটে পড়ে যেতে পারেন।

উদ্বেগজনিত ব্যাধির মূল কারণ অজানা। তবে বিশেষজ্ঞ এবং গবেষকদের মতে, জেনেটিক, পরিবেশগত, মনস্তাত্ত্বিক, ব্যক্তিত্ব, জীবনের ঘটনাসহ বিভিন্ন কারণের সংমিশ্রণ জড়িত। বলা হয়, উদ্বেগজনিত রোগ পরিবারে পূর্ব থেকেই থাকতে পারে। পরিবেশগত কারণের ক্ষেত্রে চাপ বা আঘাতমূলক ঘটনা যেমন-অপব্যবহার, প্রিয়জনের মৃত্যু, সহিংসতা বা দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতা প্রায়শই উদ্বেগ ব্যাধি বিকাশের সঙ্গে যুক্ত থাকে।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, উদ্বেগজনিত ব্যাধির একাধিক উপসর্গ দেখা দিতে পারে। যার প্রত্যেকটির চরিত্র আলাদা। উদ্বেগজনিত ব্যাধির বিভিন্ন ধরনের উপসর্গের মধ্যে শ্রেণিগত উপসর্গের মধ্যে আছে—ঘুমের সমস্যা, বুক ধড়ফড় করা, শ্বাসকষ্ট, অস্থিরতা, হাত-পা ঝিম ধরা বা কাঁপা, ঘাম হওয়া, মুখ শুকিয়ে যাওয়া, বমিভাব, মাথা ঘোরা এবং পেশি টান টান হয়ে যাওয়া।

উদ্বেগ আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যকে দুর্বল করে দেয়। উদ্বেগের কারণে আমরা অনিয়ন্ত্রিত অতিরিক্ত চিন্তার সম্মুখীন হই এবং ভয়, আতঙ্ক বা আসন্ন বিপদের অনুভূতি ধারণ করি। আমাদের খিটখিটে অনুভূতি, সবকিছুতে উচ্চতর সতর্কতা লক্ষণীয় হয়। অনেক সময় ওই পরিবেশ বা পরিস্থিতি থেকে আমরা পালাতে চাই আমরা। পরিবেশটাকে অনিরাপদ মনে হয়। নিজের বাছাই করা একটা নির্দিষ্ট অবস্থান বা পরিবেশকে নিরাপদ মনে হয় কেবল।

ইউনাইটেড স্টেইটস্ ডিপার্টমেন্ট অফ হেল্থ এন্ড হিউম্যান সার্ভিস(HHS) এর ‘মেন্টাল হেল্থ এন্ড সাবস্টেন্স এবিউজ’ নামক আর্টিক্যালের তথ্য অনুযায়ী, অনেকগুলোর মধ্যে পাঁচটি প্রধান ধরনের উদ্বেগজনিত ব্যাধি হল-
জেনারালাইজড অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার(Generalized Anxiety Disorder-GAD), পেনিক ডিসঅর্ডার (Panic Disorder), অবসেসিভ কমপালসিভ ডিসঅর্ডার(Obsessive-Compulsive Disorder-OCD), পোষ্ট ট্রাউমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার(Post-Traumatic Stress Disorder-PTSD), এবং সোস্যাল ফোবিয়া কিংবা সোস্যাল অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার (Social Phobia or Social Anxiety Disorder)!

*জেনারালাইজড অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার- এটি একটি উদ্বেগজনিত ব্যাধি যা দীর্ঘস্থায়ী ও অতিরঞ্জিত উদ্বেগ এবং উত্তেজনা দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। এমনকি উত্তেজিত করার জন্য সামান্য কিছু না ঘটলেও এটি ঘটতে পারে।

*অবসেসিভ-কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার-অবসেসিভ-কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার বা ওসিডি একটি উদ্বেগজনিত ব্যাধি এবং এটি পুনরাবৃত্তিমূলক। অবাঞ্ছিত চিন্তা অথবা পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণ (বাধ্যতামূলক) দ্বারা এটিকে চিহ্নিত করা হয়। পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণ যেমন-বার বার হাত ধোয়া, গণনা করা, পরীক্ষা করা বা পরিষ্কার করা প্রায়শই আবেগের চিন্তাভাবনা রোধ দ্বারা সঞ্চালিত হয়। এই সব অভ্যাসগুলো শুধুমাত্র সাময়িক স্বস্তি প্রদান করে। তবে সেগুলি পালন না করার ফলে উদ্বেগ বৃদ্ধি পায়।

*প্যানিক ডিসঅর্ডার-প্যানিক ডিসঅর্ডার একটি উদ্বেগজনিত ব্যাধি এবং শারীরিক লক্ষণগুলির সাথে তীব্র ভয়ের অপ্রত্যাশিত এবং পুনরাবৃত্তি পর্ব দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। যেমন- বুকে ব্যথা, হৃদস্পন্দন, শ্বাসকষ্ট, মাথা ঘোরা, বা পেটের ব্যাথা অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।

*পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার- পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার একটি উদ্বেগজনিত ব্যাধি যা কোন ভয়াবহ ঘটনার সম্মুখীন হওয়ার মত অভিজ্ঞতা থেকে ঘটতে পারে, যেখানে ব্যক্তি মারাত্মক শারীরিক ক্ষতি বা হুমকির সম্মুখীন হয়েছিল। এটিকে উত্তেজিত করতে পারা আঘাতমূলক ঘটনাগুলির মধ্যে রয়েছে, সহিংস ব্যক্তিগত আক্রমণ, প্রাকৃতিক বা মানব-সৃষ্ট দুর্যোগ, দুর্ঘটনা বা সামরিক লড়াই।

সোস্যাল ফোবিয়া বা সামাজিক উদ্বেগ ব্যাধি-এটি একটি উদ্বেগ ব্যাধি যা দৈনন্দিন সামাজিক পরিস্থিতিতে অত্যধিক উদ্বেগ এবং অত্যধিক আত্ম-সচেতনতা দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। সোস্যাল ফোবিয়া শুধুমাত্র এক ধরনের পরিস্থিতিতে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে – যেমন কোন আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক পরিস্থিতিতে কথা বলার ভয়, বা অন্যের সামনে খাওয়া বা পান করার ভয়। অর্থাৎ সামাজিক যোগাযোগ তাদের ভীত ও অস্বস্থিকর পরিবেশ দেয়।

উদ্বেগজনিত রোগের লক্ষণগুলো অনেকটাই অস্পষ্ট।  যদি আপনার মধ্যে এমন কোন লক্ষণ থাকে, তবে আপনাকে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে। ডাক্তাররা সাধারণত পরীক্ষার আগে মেডিকেল হিস্ট্রি সম্পর্কে জানতে চান এবং তারপর পরীক্ষা করেন। এ সময় তারা অন্যান্য স্বাস্থ্যজনিত বিষয়গুলো নিয়েও পরীক্ষা চালাতে পারেন যা আপনার লক্ষণগুলির কারণ হতে পারে। কোন ল্যাব পরীক্ষা বিশেষভাবে উদ্বেগজনিত রোগ নির্ণয় করতে পারে না। যদি আপনার ডাক্তার আপনার অনুভূতির কোন শারীরিক কারণ খুঁজে না পান, তাহলে তারা আপনাকে একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, মনোবিজ্ঞানী, বা অন্য মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠাতে পারেন। সেই ডাক্তাররা আপনাকে বিভিন্ন প্রশ্ন জিজ্ঞাসার মাধ্যমে আপনার উদ্বেগজনিত ব্যাধির কারণ নির্ণয়ে টুলস এবং টেস্টিং ব্যবহার করবেন। চিকিৎসকরা আপনার রোগ নির্ণয়ের সময় কতদিন যাবত আপনার লক্ষণগুলো স্পষ্ট হচ্ছে এবং সেগুলি কতটা তীব্র তা বিবেচনা করবে।
এ ক্ষেত্রে অবশ্যয়ই আপনাকে দুশ্চিন্তা বাড়িতে, কর্মক্ষেত্রে বা স্কুলে দৈনন্দিন কাজগুলি উপভোগ করতে বা সম্পন্ন করতে বাধাগ্রস্থ্য করে কিনা, তা ডাক্তার বা পরামর্শদাকে জানানো খুব গুরুত্বপূর্ণ।

উদ্বেগজনিত রোগের চিকিৎসা করা যায় এবং এর জন্য বেশ কয়েকটি কার্যকর চিকিৎসা রয়েছে যা অধিকাংশ মানুষকে স্বাভাবিক উৎপাদনশীল জীবনযাপন করতে সাহায্য করে। যেমন-কাউন্সেলিং, সাইকো থেরাপি, ঔষদ! উদ্বেগজনিত রোগের চিকিৎসা বা মেডসিনের বিষয়ে আপনার চিকিৎসকই উপযুক্ত পরামর্শদাতা।

PA LINK