আমাদের শব্দ ও ভাষাগত ত্রুটি

ভাষা হল কাঠামোগত এবং প্রচলিত উপায়ে শব্দের ব্যবহার দ্বারা কথিত বা লিখিত মানব যোগাযোগের একটি পদ্ধতি, যার মাধ্যমে আমরা আমাদের নিজস্ব অনুভুতি, চিন্তা চেতনা, আবেগ প্রকাশ করে থাকি। প্রায় সময়ই আমরা যে শব্দগুলি বলে থাকি বা লিখে থাকি, সেগুলি অন্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করতে পারে এবং স্থায়ী স্মৃতিতে দুর্দান্ত প্রভাব ফেলতে পারে, হোক সেটা ভাল বা মন্দ। তাই ব্যবহারের আগে শব্দগুলো বুদ্ধিমানের সাথে বেছে নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
জালাল উদ্দিন রুমি বলেছিলেন, “Raise your words, not voice. It is rain that grows flowers, not thunder.” অনেক ক্ষেত্রে আমাদের রাগ ক্ষোভের বহিপ্রকাশ হলো নেতিবাচক শব্দের ব্যবহারে মন্তব্য করা। আবার অনেক সময় হাসতে হাসতেও আমরা এমন সব কথা বলি যা মূলত ‌অন্যকে হেয় করে, আঘাত করে। আমরা বুঝে না বুঝে এই কাজগুলো করে থাকি। যেমন- অনেক সময় কারো প্রতি ক্ষোভ প্রকাশে কেউ কেউ বলে থাকেন, ‘সে একটা অটিস্টিক/‘প্রতিবন্ধি।’ অপছন্দের ব্যক্তিটিকে বলা হয় সিজোফ্রেনিক।
শুধু তাই নয়! বর্তমান কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবকালীন সময়ে আমাদের প্রেসিডেন্ট ডোনাল ট্র্যাম্প এবং গভর্ণর এন্ড্রো কুওমোর মাঝে পাবলিকলি বাক বিতন্ডতা চলছে। এটাই রাজনীতি। তারা যেমন জানেন এর কারণ, আমরা সাধারণ জনগনও জানি এর মূল কারণ। এই রাজনীতি নিয়ে আলোচনা সমালোচনা হবে, এটাই স্বাভাবিক। এবং রাজনীতিবিদরা এটাই চান। তবে এ ক্ষেত্রে আলোচনা-সমালোচনা করতে গিয়ে শব্দ এবং ভাষার অপব্যবহার করা, আলোচনা-সমালোচনার উর্ধে। যেমন- ট্রাম্পের প্রতি ক্ষুদ্ধ কেউ কেউ পাগল, স্টুপিড, মানসিক রোগী, পাগলাগারদে ডুকানো দরকার, …ইত্যাদি ইত্যাদি শব্দগুলো প্রয়োগ করছেন সোস্যাল মিডিয়াতে। কারো প্রতি ক্ষোভ প্রকাশে এই শব্দগুলো আমাদের সমাজে খুবই স্বাভাবিক শব্দ হলেও, ডিপার্টমেন্ট অফ এডুকেশন এবং সাইকোলজিক্যাল ডিপার্টমেন্টে এগুলো খুবই বিরুপ প্রতিক্রীয়ামূলক শব্দ। এবং এই ধরণের শব্দ পরিহার করা বাধ্যতামূলক।
এই যে আমাদের শব্দ ও ভাষাগত ত্রুটিগুলো রোজ প্রকাশ হচ্ছে কিন্তু আমরা কেউ সেটা বুঝতেই পারছিনা, এর কারণ কি? কারণ শুধু শিক্ষাগত অদক্ষতাই নয়, বরং আমাদের নষ্ট হয়ে যাওয়া মানবিকতা ও বিবেচনাহীন বিবেক এর জন্য দায়ী। একজন মানুষ হয়ে আরেকজন মানুষকে কি করে পাগল, স্টুপিড বলা যায়? কি করে ক্ষোভ প্রকাশ করতে কাউকে সিজোফ্রেনিক, অটিস্টিক বলা যায়? এটা অন্যের প্রতি মৌখিক আক্রমন। আমাদের বুঝতে হবে যে সমালোচনা আর মৌখিক আক্রমন এক নয়।
অটিজম এক ধরণের জটিল স্নায়বিক বিকাশ সংক্রান্ত মস্তিষ্কের রোগ। সিজোফ্রেনিয়া একটি সাইকোলোজিক্যাল, বায়োলজিক্যাল রোগ। এই রোগে আক্রান্তরা নিরপরাধ। তারা জানেনা এই রোগটি কিভাবে এসেছে, কেন এসেছে। তাহলে আমরা কেন ‌‌অন্যের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করতে গিয়ে এই শব্দগুলো টেনে আনছি? কেন এই শব্দগুলো ব্যবহারে আমরা অটিস্টিক এবং সিজোফ্রেনিকদের আমাদের শ্রেণি থেকে পৃথক করছি? বৈষম্য করছি? আমাদের সে অধীকার কে দিয়েছে?
আমার লিখাটি পড়ে কেউ কেউ আমার প্রতি মারাত্মক ক্ষোভ প্রকাশ করতে পারেন। আমি তাতে মোটেও বিচলিত নই। হ্যা, এটাই আমি। আমার প্রোফেশন এবং ডিপার্টমেন্ট আমাকে এভাবেই গড়েছেন। যখন কোন স্টুডেন্ট রেগে গিয়ে আমাদের শারীরিক ভাবে আঘাত করে, আমরা তখন কখনোই বলিনা ‘স্টপ দিস’ কিংবা ‘ডু নট ডু দিস!’ আমরা বলি, ‘ইজ ইট নাইস টু ডু দিস?’ কিংবা বলি, ‘ক্যান উই ডু সামথিং এল্স?’ ইতিবাচক রেসপন্সে আমরা ভয়ংকর সমস্যাও মোকাবেলা করতে শিখেছি। আর যখন দৈনন্দিন পাশে থেকে সেবা ও শিক্ষা দিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর রোগ নিয়ে সাধারণ জনগনকে তাদের ক্ষোভ প্রকাশে ব্যবহার করতে দেখি, তখন আমিও ক্ষোভে আক্রান্ত হই।
আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহারিক শব্দগুলো খুব যত্নের সাথে বেছে নিয়ে ব্যবহার করা উচিৎ কারণ এতে ‌ইতিবাচক বা নেতিবাচকভাবে অন্যরা প্রভাবিত হয়। আমাদের একটি মাত্র নেতিবাচক মন্তব্য একজন ব্যক্তির ব্যক্তিজীবন এবং দিনটিকে নষ্ট করে দিতে পারে। সর্বক্ষেত্রে একটি ইতিবাচক এবং উৎসাহমূলক মন্তব্য অন্যদের মনোবল বৃদ্ধি এবং স্বাস্থ্যকর সংস্কৃতি তৈরি করতে সক্ষম হয় এবং কারো জীবনে আরও বেশি পার্থক্য তৈরি করতে পারে যা হয়তো আমরা কখনও জানতেও পারবো না।
আমাদের কথা বলার স্বর এবং মনোভাব পাশের ব্যক্তিকে প্রতিবিম্বিত করে এবং আমাদের চারপাশের সমস্ত কিছুকে প্রভাবিত করে। এটি আমাদের ব্যক্তিগত জীবন এবং সামাজিক জীবন উভয় ক্ষেত্রে আমাদের সাফল্য বা অসাফল্যে ব্যাপক অবদান রাখতে পারে। সুতরাং, আমাদের কথা বলার আগে চিন্তা করে নেয়া দরকার।
আসুন আমরা জীবনের ছোট ছোট বিষয়গুলিকে উপেক্ষা করে চলি।