পৃথিবীর প্রতিটি শিশু–কিশোর–তরুণ সন্তানদের বিদায় মর্মান্তিক। আর সেটি যদি হয় হত্যা-আত্মহত্যা, তাহলে সেটার সঙ্গে যুক্ত হয় আতঙ্ক। সম্প্রতি টেক্সাসে বাঙালি পরিবারে ছয় সদস্যের হত্যা–আত্মহত্যা আমাদের মনে নানান প্রশ্নেরই জন্ম দিচ্ছে। দীর্ঘ সময় হতাশায় ভোগা ফারহান তৌহিদ (১৯) ও তানভীর তৌহিদ (২১) খুব নিপুণ পরিকল্পনায় তাদের বাবা-মা, বোন, নানিকে গুলি করে হত্যা করেন, পরে নিজেরাও আত্মহত্যা করেন।
কিন্তু কেন এই হত্যা-আত্মহত্যার প্রবণতা? এর বহু কারণ রয়েছে। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, হত্যা-আত্মহত্যার ঝুঁকিপূর্ণ কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে—অপরাধী ও ভুক্তভোগীদের মধ্যে সম্পর্ক, পারিবারিক সহিংসতা, মাদকের ব্যবহার, অপরাধীর বয়স, বিবাহবিচ্ছেদ, সম্পর্ক পৃথক্করণ, অস্ত্রের ব্যবহার, বংশগত, পরিবারে মানসিক অসুস্থতার ইতিহাস এবং হতাশা।
সুইসাইডাল নোট পড়ে জানা যায়, টেক্সাসের দুই বাংলাদেশি যুবক হতাশায় ভুগছিল। এখন আমাদের ভাবতে হবে, হতাশা কি এবং এর উৎস কোথায়!
কোনো ব্যক্তির দীর্ঘ সময় ধরে অবসন্ন মন, শক্তিহীন ও উৎসাহহীন অবস্থাকে হতাশার মধ্যে ফেলা হয়। অর্থাৎ হতাশা মনের এমন একটি মানবিক অনুভূতি, যার মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি কোনো ব্যক্তির স্বাভাবিক ক্রিয়াকলাপকে বন্ধ করে দেয়।
বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ, গবেষক, মনোবিজ্ঞানীদের মতে, হতাশা কোনো ব্যক্তির জীবনের অভিজ্ঞতাগুলোর সঙ্গে জড়িত। অর্থাৎ, কোনো ব্যক্তির মাত্রাতিরিক্ত মানসিক চাপের ফলেই হতাশার শুরু। সেটি হতে পারে নিঃসঙ্গতা, একাকিত্ব, সম্পর্কের ভাঙন, প্রকৃত বন্ধু না থাকা, বেকারত্ব, পারিবারিক সহিংসতা, প্রিয়জনের মৃত্যু, বিদ্যালয়ে বুলিং, পড়াশোনার চাপ, পেরেন্টিং বা অভিভাবকত্বের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন না করা, শিশু নিপীড়ন, প্রশংসা না পাওয়া এবং জেনেটিক…ইত্যাদি।
হতাশায় ভোগার বহুবিদ কারণের মধ্যে আমরা দেখতে পাচ্ছি একটি কারণ হলো, অভিভাবকত্বের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন না করা। হ্যাঁ! সন্তানের সঠিক পরিচর্যায় সঠিক অভিভাবকত্ব অনস্বীকার্য। তাহলে জেনে নিই, অভিভাবকত্বের ধরন কি?
বাবা–মা হিসেবে অভিভাবকত্বের ধরন হচ্ছে এমন একটি মনস্তাত্ত্বিক গঠন (psychological construct), যা মা-বাবা তাদের সন্তানকে লালন-পালন করতে ব্যবহার করে থাকেন। প্রয়োজনমতো আদর ভালোবাসা ও শাসনে ভারসাম্য রেখে সন্তানের ভালো-মন্দ, ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে প্রাধান্য দেওয়া এবং তাদের প্রতি সব ধরনের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করাকেই মূলত অভিভাবকত্ব বোঝায়।
অভিভাবকত্ব চার ধরনের—অথোরিটেরিয়ান বা কর্তৃত্বপরায়ণ, অথোরিটেটিভ বা অধিকারমূলক, পার্মেসিভ বা সহনশীল এবং আন-ইনভলভড বা বিচ্ছিন্ন অভিভাবকত্ব।
অথোরিটেরিয়ান পেরেন্টিংয়ে দেখা যায়, মা-বাবাই সন্তানের জন্য যাবতীয় নিয়মকানুন ও নির্দিষ্ট সাফল্য নির্ধারণ করে থাকেন। এখানে সন্তানের পছন্দ-অপছন্দ, ইচ্ছা-অনিচ্ছার তেমন কোনো প্রাধান্য নেই। সন্তান কী খাবে, কী পরবে, কার সঙ্গে মিশবে এবং বড় হয়ে সে কী হতে চায়, সব মা-বাবাই নির্ধারণ করেন। সন্তান যদি কোনো সিদ্ধান্তের কারণ জানতে চায়, তাহলে মা-বাবার উত্তর হবে, ‘আমি বলেছি তাই করতে হবে। কিংবা আমি তোমার অভিভাবক, যা বলব তাই শুনতে হবে।’
এই অভিভাবকত্বের ধরনে সন্তানকে কোনো ধরনের পছন্দ দেওয়া হয় না। একচ্ছত্রভাবে মা-বাবাই নির্ধারণ করেন সন্তানের সব সিদ্ধান্ত। এই জাতীয় মা-বাবারা অনেক সময় সন্তানের ভুলের জন্য তাকে শাস্তি দিয়ে থাকেন। যেমন, চড়–থাপ্পড়, ঝাঁকুনি, বেত্রাঘাত, কটু ভাষায় তিরস্কার, খাবার না দেওয়া, প্রিয় কাজটি করতে না দেওয়া।
অথোরিটেরিয়ান পেরেন্টিংয়ের পরিণামে সন্তানের আত্মবিশ্বাস কমে যেতে পারে, হতাশায় ভুগতে পারে, মা-বাবার প্রতি অশ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠতে পারে, সিদ্ধান্ত তৈরি ও সমস্যা সমাধানে হিমশিম খেতে পারে, মানসিক সঠিক বিকাশে ব্যাহত হতে পারে, শারীরিক শাস্তির কারণে মানসিক, শারীরিক ও স্নায়ুবিক সমস্যার তৈরি হতে পারে।
অথোরিটেটিভ পেরেন্টিংয়ে মা-বাবা সাধারণত সন্তানের জন্য নিয়মাবলি ও লক্ষ্য নির্ধারণ করলেও সেটা কেন করেছেন এবং তার সুফল/কুফল কী হতে পারে—তা সন্তানকে ব্যাখ্যা করে থাকেন। অর্থাৎ মা-বাবা এখানে সন্তানকে নিয়ন্ত্রণ করেন ঠিকই, তবে তাদের ওপর কোনো কিছু একচ্ছত্রভাবে চাপিয়ে না দিয়ে সন্তানের ইচ্ছা-অনিচ্ছার প্রাধান্য দেন এবং মা-বাবার নির্ধারিত প্রতিটি সিদ্ধান্তের পেছনে যথার্থ কারণ নিয়ে সন্তানের সঙ্গে আলোচনা করেন। এই পদ্ধতিতে মা-বাবা সন্তানকে তার ভুলের জন্য শাস্তি না দিয়ে, ফলাফল কী হতে পারে তা নিয়ে আলোচনা করেন।
যেমন, সন্তান পরীক্ষায় ফেল করল। মা-বাবা তাকে গালি বা কটাক্ষ না করে, অন্যের সঙ্গে সন্তানকে তুলনা না করে, কীভাবে আরও ভালো করা যায়, তা নিয়ে উৎসাহ দেবেন এবং তার ভবিষ্যৎ ও মা-বাবার আশা পূরণে পাস করা কতটা জরুরি, তা নিয়ে সন্তানের সঙ্গে ইতিবাচক আলোচনা করবেন।
ধরুন, আপনার মেয়ে সন্তানকে মধ্যরাতে বাইরে যেতে মানা করছেন। সে আপনাকে জিজ্ঞেস করল, কেন সে যেতে পারবে না? অভিভাবক হিসেবে, আপনি তাকে ‘তুমি মেয়ে, তাই এত রাতে বাইরে যাওয়া ঠিক না’—এই কথাটি বলবেন না। বরং মধ্যরাতে একা বাইরে গেলে সে কী কী সমস্যায় পড়তে পারে এবং যদি পাশে আপন কেউ না থাকে, তাহলে কতটা ভয়াবহ বিপদ হতে পারে—তা ব্যাখ্যা করবেন। এতে করে মেয়ে হয়ে জন্ম নেওয়ায় সন্তানটির কোনো আক্ষেপ থাকবে না এবং তার ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ সতর্কতামূলক হবে।
এই পদ্ধতিটি যদি সন্তানের ক্ষেত্রে কাজে না লাগে, তবে সন্তানের আগ্রহ বাড়াতে মা-বাবা শাস্তির পরিবর্তে অনেক সময় রি-এনফোর্সমেন্ট বা সন্তানকে মানসিকভাবে বলিয়ান করার ব্যবস্থা করে থাকেন। যেমন, সন্তান যদি নির্ধারিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে, তাহলে হয়তো তার প্রিয় খাবার/টয়/ডিভাইস/বস্তুটি পুরস্কার হিসেবে রাখা যেতে পারে।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, স্কুল থেকে শুরু করে পারিবারিক শাসনেও অথোরিটেটিভ পেরেন্টিংয়ে ছেলে-মেয়েরা বেশি সাফল্য অর্জন করে থাকে। যেমন-ব্যক্তি জীবনে সাফল্য, আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি, দৃঢ় মনোবল, একাডেমিক সাফল্য, ভালো-মন্দের পার্থক্য নির্ণয়, ঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ায় একাগ্রতা।
পার্মেসিভ পেরেন্টিং ধরনে মা-বাবা সাধারণত সন্তানের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলেন ঠিকই, কিন্তু এখানে সঠিক শাসন বা নিয়মাবলিতে ঘাটতি থাকে। সন্তানের ব্যর্থতায় মা-বাবা তাদের শাস্তি দেন; তবে সন্তানকে সফল করে তুলতে কোন পদক্ষেপটি নেওয়া দরকার, তা নিয়ে ভাবেন না। যতক্ষণ পর্যন্ত সন্তান কোনো বড় ধরনের ভুল করে না বসবে, ততক্ষণ পর্যন্ত মা-বাবা হস্তক্ষেপ করেন না। এবং যেকোনো ভুলের কারণে শাস্তি রাখেন। তবে সে ভুলের যেন পুনরাবৃত্তি না হয়, তার পক্ষে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি মনে করেন না।
এর পরিণামে সন্তানের সঙ্গে যা হয় তা হলো—বিচ্ছিন্নতা বা বিগড়ে যাওয়া, অসম্মান প্রদর্শন করা, সামাজিক নিয়ম ভঙ্গ করা, স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠা, আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি, স্কুলে খারাপ রেজাল্ট করা… ইত্যাদি হয়ে থাকে।
আন-ইনভলভড পেরেন্টিং ধরনে সাধারণত মা-বাবা সন্তানের প্রতি অবহেলা প্রদর্শন করে থাকেন। তারা সন্তানের চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হন। কিন্তু সন্তানের কাছে তাদের আশানুরূপ সাফল্য আশা করতে ছাড়েন না। সন্তান স্কুলে ঠিকমতো গেল গেল কিনা, স্কুল ফাঁকি দিচ্ছে কিনা, হোমওয়ার্ক করল কিনা, বুলিং হচ্ছে কিনা, কোনো কারণে হতাশ কিনা, খেতে চাচ্ছে না কেন, সময়মতো ঘুমাচ্ছে না কেন, অস্বাভাবিক আচরণ করছে কেন, ইত্যাদি বিষয়গুলো এড়িয়ে যান। অর্থাৎ মা-বাবা হিসেবে সঠিক পরিচর্যা ও গাইডেন্সের অভাব। গবেষণায় দেখা গেছে, অ্যাডিকশন, দারিদ্র্য, অশিক্ষা, এ ধরনের পেরেন্টিং এর জন্য দায়ী।
আন-ইনভলভড পেরেন্টিংয়ের পরিণাম ক্ষতিকর। এতে সন্তানদের মনোবল দুর্বল হয়ে পড়ে, হতাশা দেখা দেয়, রাগ বেড়ে যায়, অসামাজিক আচরণ বৃদ্ধি পায়, নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে, একাডেমিক সাফল্যে চরম ব্যর্থতা দেখা দেয়।
তাই সন্তান পরিচর্যা ও লালন-পালনে মা-বাবার ভূমিকা অপরিসীম।
সন্তানকে শাসন করুন, তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় তাকে বুঝিয়ে গাইড করুন। কিন্তু মনে রাখবেন, সন্তান যেন আপনাকে একজন শাসকের দৃষ্টিতে না দেখে, বরং সন্তান যেন আপনার কাছে নিরাপদ ও স্বস্তিবোধ করার পরিবেশটা খুঁজে পায়।
সন্তানের পরিচর্যায় তার জন্য কিছুটা স্পেস রাখুন। তাকে বলতে দিন, আপনি শুনুন। তার চাহিদায় ভুল থাকলে সেটা তাকে বুঝিয়ে বলুন। ভালো কিছু আইডিয়া থাকলে, সন্তানকে প্রশংসা করতে ভুলবেন না।
দৈনিক কিছুটা সময় দিন সন্তানকে। সন্তানের পাশে বসুন। সে কেমন অনুভব করছে, স্কুলে আজ মজার বা তিক্ত কিছু ঘটেছে কিনা, ইত্যাদি নিয়ে গল্প করুন। মাঝে মাঝে সন্তানকে নিয়ে আচমকা কোথাও খেতে বা বেড়াতে চলে যান। সন্তানের সঙ্গে খেলুন। বাড়তি কিছু আনন্দ দিয়ে সন্তানের ‘বেস্ট ফ্রেন্ড’ লিস্টে জায়গা করে নিন। কোনো ভুল করে ফেললেও যেন সে বাইরে নয়, আপনার কাছে সমাধান খোঁজে, এমন একটি পরিবেশ তৈরি করুন। এবং আপনি যেন তার সেই ভুল শোধরাতে সক্ষম হন, সেটাও বিবেচনায় রাখতে হবে।
সন্তানের মেধা কোথায়? খুঁজে দেখুন। আপনার সন্তান যদি স্পোর্টসে যথেষ্ট পরিমাণ মেধা নিয়ে জন্মে থাকে, তাহলে তাকে ডাক্তার বানানোর বৃথা চেষ্টা করবেন না। জোরপূর্বক তার ওপর নির্দিষ্ট লক্ষ্য চাপিয়ে দিলে ক্যারিয়ার হুমকির সম্মুখীন হবে। সন্তানের আকর্ষণ কী নিয়ে জানুন এবং সে অনুযায়ীই তার ভবিষ্যৎ লক্ষ্য নির্ধারণ করার চেষ্টা করুন।
সন্তানকে কোনো বিধি-নিষেধ নির্ধারণ করে দিতে হলে সেটার কারণও তাকে ব্যাখ্যা করুন। তাহলে ভালো-মন্দের পার্থক্য ও ফলাফলটাও তার কাছে পরিষ্কার হবে। পরবর্তীতে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করবে।
সন্তান পরীক্ষায় ফেল করলে, কোনো অপরাধ করলে কিংবা আপনার আশানুরূপ সাফল্য অর্জন করতে না পারলে, তাকে মারধর, তিরস্কার বা গালাগালি না করে, তার ব্যর্থতার কারণ ধরিয়ে দিন এবং তাকে পরবর্তী সাফল্যের জন্য উৎসাহ ও সাহায্য দিন।
প্রতিটি মা-বাবাই সন্তানকে ভালোবাসে, যত্ন করে। কিন্তু অনেক সময় যা করা হয় না, তা হলো সঠিক অভিভাবত্ব কীভাবে করা হবে—সেই কৌশলটি বেছে নেওয়া। ভুল অভিভাবকত্ব সন্তানের হতাশায় পড়ে যাওয়ার একটি বিরাট কারণ। তাই, আমাদের সতর্ক হতে হবে।
PA LINK
আদর্শ অভিভাবক যেভাবে হবেন
পৃথিবীর প্রতিটি শিশু–কিশোর–তরুণ সন্তানদের বিদায় মর্মান্তিক। আর সেটি যদি হয় হত্যা-আত্মহত্যা, তাহলে সেটার সঙ্গে যুক্ত হয় আতঙ্ক। সম্প্রতি টেক্সাসে বাঙালি পরিবারে ছয় সদস্যের হত্যা–আত্মহত্যা আমাদের মনে নানান প্রশ্নেরই জন্ম দিচ্ছে। দীর্ঘ সময় হতাশায় ভোগা ফারহান তৌহিদ (১৯) ও তানভীর তৌহিদ (২১) খুব নিপুণ পরিকল্পনায় তাদের বাবা-মা, বোন, নানিকে গুলি করে হত্যা করেন, পরে নিজেরাও আত্মহত্যা করেন।
কিন্তু কেন এই হত্যা-আত্মহত্যার প্রবণতা? এর বহু কারণ রয়েছে। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, হত্যা-আত্মহত্যার ঝুঁকিপূর্ণ কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে—অপরাধী ও ভুক্তভোগীদের মধ্যে সম্পর্ক, পারিবারিক সহিংসতা, মাদকের ব্যবহার, অপরাধীর বয়স, বিবাহবিচ্ছেদ, সম্পর্ক পৃথক্করণ, অস্ত্রের ব্যবহার, বংশগত, পরিবারে মানসিক অসুস্থতার ইতিহাস এবং হতাশা।
সুইসাইডাল নোট পড়ে জানা যায়, টেক্সাসের দুই বাংলাদেশি যুবক হতাশায় ভুগছিল। এখন আমাদের ভাবতে হবে, হতাশা কি এবং এর উৎস কোথায়!
কোনো ব্যক্তির দীর্ঘ সময় ধরে অবসন্ন মন, শক্তিহীন ও উৎসাহহীন অবস্থাকে হতাশার মধ্যে ফেলা হয়। অর্থাৎ হতাশা মনের এমন একটি মানবিক অনুভূতি, যার মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি কোনো ব্যক্তির স্বাভাবিক ক্রিয়াকলাপকে বন্ধ করে দেয়।
বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ, গবেষক, মনোবিজ্ঞানীদের মতে, হতাশা কোনো ব্যক্তির জীবনের অভিজ্ঞতাগুলোর সঙ্গে জড়িত। অর্থাৎ, কোনো ব্যক্তির মাত্রাতিরিক্ত মানসিক চাপের ফলেই হতাশার শুরু। সেটি হতে পারে নিঃসঙ্গতা, একাকিত্ব, সম্পর্কের ভাঙন, প্রকৃত বন্ধু না থাকা, বেকারত্ব, পারিবারিক সহিংসতা, প্রিয়জনের মৃত্যু, বিদ্যালয়ে বুলিং, পড়াশোনার চাপ, পেরেন্টিং বা অভিভাবকত্বের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন না করা, শিশু নিপীড়ন, প্রশংসা না পাওয়া এবং জেনেটিক…ইত্যাদি।
হতাশায় ভোগার বহুবিদ কারণের মধ্যে আমরা দেখতে পাচ্ছি একটি কারণ হলো, অভিভাবকত্বের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন না করা। হ্যাঁ! সন্তানের সঠিক পরিচর্যায় সঠিক অভিভাবকত্ব অনস্বীকার্য। তাহলে জেনে নিই, অভিভাবকত্বের ধরন কি?
বাবা–মা হিসেবে অভিভাবকত্বের ধরন হচ্ছে এমন একটি মনস্তাত্ত্বিক গঠন (psychological construct), যা মা-বাবা তাদের সন্তানকে লালন-পালন করতে ব্যবহার করে থাকেন। প্রয়োজনমতো আদর ভালোবাসা ও শাসনে ভারসাম্য রেখে সন্তানের ভালো-মন্দ, ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে প্রাধান্য দেওয়া এবং তাদের প্রতি সব ধরনের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করাকেই মূলত অভিভাবকত্ব বোঝায়।
অভিভাবকত্ব চার ধরনের—অথোরিটেরিয়ান বা কর্তৃত্বপরায়ণ, অথোরিটেটিভ বা অধিকারমূলক, পার্মেসিভ বা সহনশীল এবং আন-ইনভলভড বা বিচ্ছিন্ন অভিভাবকত্ব।
অথোরিটেরিয়ান পেরেন্টিংয়ে দেখা যায়, মা-বাবাই সন্তানের জন্য যাবতীয় নিয়মকানুন ও নির্দিষ্ট সাফল্য নির্ধারণ করে থাকেন। এখানে সন্তানের পছন্দ-অপছন্দ, ইচ্ছা-অনিচ্ছার তেমন কোনো প্রাধান্য নেই। সন্তান কী খাবে, কী পরবে, কার সঙ্গে মিশবে এবং বড় হয়ে সে কী হতে চায়, সব মা-বাবাই নির্ধারণ করেন। সন্তান যদি কোনো সিদ্ধান্তের কারণ জানতে চায়, তাহলে মা-বাবার উত্তর হবে, ‘আমি বলেছি তাই করতে হবে। কিংবা আমি তোমার অভিভাবক, যা বলব তাই শুনতে হবে।’
এই অভিভাবকত্বের ধরনে সন্তানকে কোনো ধরনের পছন্দ দেওয়া হয় না। একচ্ছত্রভাবে মা-বাবাই নির্ধারণ করেন সন্তানের সব সিদ্ধান্ত। এই জাতীয় মা-বাবারা অনেক সময় সন্তানের ভুলের জন্য তাকে শাস্তি দিয়ে থাকেন। যেমন, চড়–থাপ্পড়, ঝাঁকুনি, বেত্রাঘাত, কটু ভাষায় তিরস্কার, খাবার না দেওয়া, প্রিয় কাজটি করতে না দেওয়া।
অথোরিটেরিয়ান পেরেন্টিংয়ের পরিণামে সন্তানের আত্মবিশ্বাস কমে যেতে পারে, হতাশায় ভুগতে পারে, মা-বাবার প্রতি অশ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠতে পারে, সিদ্ধান্ত তৈরি ও সমস্যা সমাধানে হিমশিম খেতে পারে, মানসিক সঠিক বিকাশে ব্যাহত হতে পারে, শারীরিক শাস্তির কারণে মানসিক, শারীরিক ও স্নায়ুবিক সমস্যার তৈরি হতে পারে।
অথোরিটেটিভ পেরেন্টিংয়ে মা-বাবা সাধারণত সন্তানের জন্য নিয়মাবলি ও লক্ষ্য নির্ধারণ করলেও সেটা কেন করেছেন এবং তার সুফল/কুফল কী হতে পারে—তা সন্তানকে ব্যাখ্যা করে থাকেন। অর্থাৎ মা-বাবা এখানে সন্তানকে নিয়ন্ত্রণ করেন ঠিকই, তবে তাদের ওপর কোনো কিছু একচ্ছত্রভাবে চাপিয়ে না দিয়ে সন্তানের ইচ্ছা-অনিচ্ছার প্রাধান্য দেন এবং মা-বাবার নির্ধারিত প্রতিটি সিদ্ধান্তের পেছনে যথার্থ কারণ নিয়ে সন্তানের সঙ্গে আলোচনা করেন। এই পদ্ধতিতে মা-বাবা সন্তানকে তার ভুলের জন্য শাস্তি না দিয়ে, ফলাফল কী হতে পারে তা নিয়ে আলোচনা করেন।
যেমন, সন্তান পরীক্ষায় ফেল করল। মা-বাবা তাকে গালি বা কটাক্ষ না করে, অন্যের সঙ্গে সন্তানকে তুলনা না করে, কীভাবে আরও ভালো করা যায়, তা নিয়ে উৎসাহ দেবেন এবং তার ভবিষ্যৎ ও মা-বাবার আশা পূরণে পাস করা কতটা জরুরি, তা নিয়ে সন্তানের সঙ্গে ইতিবাচক আলোচনা করবেন।
ধরুন, আপনার মেয়ে সন্তানকে মধ্যরাতে বাইরে যেতে মানা করছেন। সে আপনাকে জিজ্ঞেস করল, কেন সে যেতে পারবে না? অভিভাবক হিসেবে, আপনি তাকে ‘তুমি মেয়ে, তাই এত রাতে বাইরে যাওয়া ঠিক না’—এই কথাটি বলবেন না। বরং মধ্যরাতে একা বাইরে গেলে সে কী কী সমস্যায় পড়তে পারে এবং যদি পাশে আপন কেউ না থাকে, তাহলে কতটা ভয়াবহ বিপদ হতে পারে—তা ব্যাখ্যা করবেন। এতে করে মেয়ে হয়ে জন্ম নেওয়ায় সন্তানটির কোনো আক্ষেপ থাকবে না এবং তার ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ সতর্কতামূলক হবে।
এই পদ্ধতিটি যদি সন্তানের ক্ষেত্রে কাজে না লাগে, তবে সন্তানের আগ্রহ বাড়াতে মা-বাবা শাস্তির পরিবর্তে অনেক সময় রি-এনফোর্সমেন্ট বা সন্তানকে মানসিকভাবে বলিয়ান করার ব্যবস্থা করে থাকেন। যেমন, সন্তান যদি নির্ধারিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে, তাহলে হয়তো তার প্রিয় খাবার/টয়/ডিভাইস/বস্তুটি পুরস্কার হিসেবে রাখা যেতে পারে।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, স্কুল থেকে শুরু করে পারিবারিক শাসনেও অথোরিটেটিভ পেরেন্টিংয়ে ছেলে-মেয়েরা বেশি সাফল্য অর্জন করে থাকে। যেমন-ব্যক্তি জীবনে সাফল্য, আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি, দৃঢ় মনোবল, একাডেমিক সাফল্য, ভালো-মন্দের পার্থক্য নির্ণয়, ঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ায় একাগ্রতা।
পার্মেসিভ পেরেন্টিং ধরনে মা-বাবা সাধারণত সন্তানের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলেন ঠিকই, কিন্তু এখানে সঠিক শাসন বা নিয়মাবলিতে ঘাটতি থাকে। সন্তানের ব্যর্থতায় মা-বাবা তাদের শাস্তি দেন; তবে সন্তানকে সফল করে তুলতে কোন পদক্ষেপটি নেওয়া দরকার, তা নিয়ে ভাবেন না। যতক্ষণ পর্যন্ত সন্তান কোনো বড় ধরনের ভুল করে না বসবে, ততক্ষণ পর্যন্ত মা-বাবা হস্তক্ষেপ করেন না। এবং যেকোনো ভুলের কারণে শাস্তি রাখেন। তবে সে ভুলের যেন পুনরাবৃত্তি না হয়, তার পক্ষে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি মনে করেন না।
এর পরিণামে সন্তানের সঙ্গে যা হয় তা হলো—বিচ্ছিন্নতা বা বিগড়ে যাওয়া, অসম্মান প্রদর্শন করা, সামাজিক নিয়ম ভঙ্গ করা, স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠা, আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি, স্কুলে খারাপ রেজাল্ট করা… ইত্যাদি হয়ে থাকে।
আন-ইনভলভড পেরেন্টিং ধরনে সাধারণত মা-বাবা সন্তানের প্রতি অবহেলা প্রদর্শন করে থাকেন। তারা সন্তানের চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হন। কিন্তু সন্তানের কাছে তাদের আশানুরূপ সাফল্য আশা করতে ছাড়েন না। সন্তান স্কুলে ঠিকমতো গেল গেল কিনা, স্কুল ফাঁকি দিচ্ছে কিনা, হোমওয়ার্ক করল কিনা, বুলিং হচ্ছে কিনা, কোনো কারণে হতাশ কিনা, খেতে চাচ্ছে না কেন, সময়মতো ঘুমাচ্ছে না কেন, অস্বাভাবিক আচরণ করছে কেন, ইত্যাদি বিষয়গুলো এড়িয়ে যান। অর্থাৎ মা-বাবা হিসেবে সঠিক পরিচর্যা ও গাইডেন্সের অভাব। গবেষণায় দেখা গেছে, অ্যাডিকশন, দারিদ্র্য, অশিক্ষা, এ ধরনের পেরেন্টিং এর জন্য দায়ী।
আন-ইনভলভড পেরেন্টিংয়ের পরিণাম ক্ষতিকর। এতে সন্তানদের মনোবল দুর্বল হয়ে পড়ে, হতাশা দেখা দেয়, রাগ বেড়ে যায়, অসামাজিক আচরণ বৃদ্ধি পায়, নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে, একাডেমিক সাফল্যে চরম ব্যর্থতা দেখা দেয়।
তাই সন্তান পরিচর্যা ও লালন-পালনে মা-বাবার ভূমিকা অপরিসীম।
সন্তানকে শাসন করুন, তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় তাকে বুঝিয়ে গাইড করুন। কিন্তু মনে রাখবেন, সন্তান যেন আপনাকে একজন শাসকের দৃষ্টিতে না দেখে, বরং সন্তান যেন আপনার কাছে নিরাপদ ও স্বস্তিবোধ করার পরিবেশটা খুঁজে পায়।
সন্তানের পরিচর্যায় তার জন্য কিছুটা স্পেস রাখুন। তাকে বলতে দিন, আপনি শুনুন। তার চাহিদায় ভুল থাকলে সেটা তাকে বুঝিয়ে বলুন। ভালো কিছু আইডিয়া থাকলে, সন্তানকে প্রশংসা করতে ভুলবেন না।
দৈনিক কিছুটা সময় দিন সন্তানকে। সন্তানের পাশে বসুন। সে কেমন অনুভব করছে, স্কুলে আজ মজার বা তিক্ত কিছু ঘটেছে কিনা, ইত্যাদি নিয়ে গল্প করুন। মাঝে মাঝে সন্তানকে নিয়ে আচমকা কোথাও খেতে বা বেড়াতে চলে যান। সন্তানের সঙ্গে খেলুন। বাড়তি কিছু আনন্দ দিয়ে সন্তানের ‘বেস্ট ফ্রেন্ড’ লিস্টে জায়গা করে নিন। কোনো ভুল করে ফেললেও যেন সে বাইরে নয়, আপনার কাছে সমাধান খোঁজে, এমন একটি পরিবেশ তৈরি করুন। এবং আপনি যেন তার সেই ভুল শোধরাতে সক্ষম হন, সেটাও বিবেচনায় রাখতে হবে।
সন্তানের মেধা কোথায়? খুঁজে দেখুন। আপনার সন্তান যদি স্পোর্টসে যথেষ্ট পরিমাণ মেধা নিয়ে জন্মে থাকে, তাহলে তাকে ডাক্তার বানানোর বৃথা চেষ্টা করবেন না। জোরপূর্বক তার ওপর নির্দিষ্ট লক্ষ্য চাপিয়ে দিলে ক্যারিয়ার হুমকির সম্মুখীন হবে। সন্তানের আকর্ষণ কী নিয়ে জানুন এবং সে অনুযায়ীই তার ভবিষ্যৎ লক্ষ্য নির্ধারণ করার চেষ্টা করুন।
সন্তানকে কোনো বিধি-নিষেধ নির্ধারণ করে দিতে হলে সেটার কারণও তাকে ব্যাখ্যা করুন। তাহলে ভালো-মন্দের পার্থক্য ও ফলাফলটাও তার কাছে পরিষ্কার হবে। পরবর্তীতে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করবে।
সন্তান পরীক্ষায় ফেল করলে, কোনো অপরাধ করলে কিংবা আপনার আশানুরূপ সাফল্য অর্জন করতে না পারলে, তাকে মারধর, তিরস্কার বা গালাগালি না করে, তার ব্যর্থতার কারণ ধরিয়ে দিন এবং তাকে পরবর্তী সাফল্যের জন্য উৎসাহ ও সাহায্য দিন।
প্রতিটি মা-বাবাই সন্তানকে ভালোবাসে, যত্ন করে। কিন্তু অনেক সময় যা করা হয় না, তা হলো সঠিক অভিভাবত্ব কীভাবে করা হবে—সেই কৌশলটি বেছে নেওয়া। ভুল অভিভাবকত্ব সন্তানের হতাশায় পড়ে যাওয়ার একটি বিরাট কারণ। তাই, আমাদের সতর্ক হতে হবে।
PA LINK
Published by HB Rita on Sunday, April 18th, 2021